এল আর বাদল : তিন দলের নেতাদের নিয়ে জাতিসংঘে গিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস৷ কিন্তু এর লক্ষ্য কি এবং এই তিন দলের নেতাকেই বা সফরসঙ্গী হিসাবে কিভাবে বাছাই করা হলো, সেই প্রশ্ন উঠেছে
ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সফরে যে ছয় রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন, তারা হলেন- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এবং জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ড. নকিবুর রহমান তারেক, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসমিন জারা৷ ----- ডয়েচেভেলে
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর একটি কারণ হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রধান দলগুলোর সমর্থন রয়েছে, এটা দেখানোর জন্যই দলীয় প্রতিনিধিদের সফরসঙ্গী করার অন্যতম কারণ৷ অন্যদিকে, মুহাম্মদ ইউনূস দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় যাতে দেশে কোনো বড় রাজনৈতিক সংকটের পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেটিও একটি কারণ৷
এই রাজনৈতিক নেতাদের একেবারে শেষ সময়ে এসে সফরকারী দলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ শুরুতে মোট চারজনকে নেয়ার কথা হয়েছিল৷ বিএনপি থেকে দুইজন এবং জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি থেকে একজন করে৷ তবে জানা গেছে, সমতা বিধানের দাবির মুখে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি থেকে আরো একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে তিনটি দলের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়৷
রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা কি অর্জন করলেন?
বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে একতাবদ্ধ দেখানোর উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের নেতাদেরও জাতিসংঘে সফরসঙ্গী করার নজির রয়েছে৷
এমন একটি নজিরের উদাহরণ তুলে ধরেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন ভারতের বিরোধী দলীয় নেতা, তখন তিনি গিয়েছেন৷ তিনি ডেলিগেশনের নেতৃত্বই দিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন৷''
তবে ভারতের সেবারের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের এবারের পরিস্থিতির পার্থক্যও তুলে ধরেন তিনি৷ হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘‘সেটা ছিলো অনেক পরিকল্পিত৷ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইড লাইনে অনেক মিটিং হয়, অনেক সাইড ইভেন্ট থাকে, আলোচনা হয়, সেমিনার হয় সেখানে রাজনৈতিক দলের নেতারা রাষ্ট্রের পক্ষে অংশ নেন৷ দেশের বিষয় তুলে ধরেন৷ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ডেলিগেশনেও অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা থাকেন৷ তারা আসলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন৷ সাবেক এই রাষ্ট্রদূত মনে করেন, রাজনৈতিক নেতাদের বিদেশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য দেশের বিষয়ে আলোচনা করা৷
তিনি বলেন, ‘‘... আমার কাছে মনে হয়েছে, যেহেতু এই অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ সবাই বেশ কয়েকদিন থাকবেন৷ এই সময় প্রধান উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ইনফরমাল লেভেলে দেশের রাজনীতি দিয়ে আলাপ আলোচনা সহজ হবে৷ আমার কাছে মনে হয়ছে, রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ভিন্ন৷ তাদের জাতিসংঘের অধিবেশনে কাজে লাগানো নয়, কাছে পাওয়া৷''
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমানও এ বিষয়ে একমত৷ তিনি মনে করেন, ‘‘প্রফেসর ইউনূস বিশ্বের নেতাদের দেখাতে চেয়েছেন সব রাজনৈতিক দল তার সাথে আছে৷ এছাড়া ছয় রাজনৈতিক নেতাকে সফরসঙ্গী করার কোনো গুরুত্ব নাই৷ এটা সিম্বলিক৷ তাদের আসলে ওখানে কোনো কাজও নাই৷ এবার প্রধান উপদেষ্টা শতাধিক লোক নিয়ে গেছেন৷ এটা এই সরকারের কাছ থেকে আশা করা যায় না৷
রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে শতাধিক মানুষকে বিদেশ সফরে নিয়ে যাওয়ার ঐতিহ্য নতুন হয়৷ অতীতে শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সফরে দলীয় নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষের সফরের খরচ নির্বাহ করা হতো রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে৷ এ নিয়ে তুমুল সমালোচনাও ছিল৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট রোখসানা খন্দকার মনে করেন, রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি৷ তিনি বলেন, ‘‘তাদের কাজ কি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার বক্তৃতার সময় উপস্থিত থাকা, বসে থাকা?''
তিনি বলেন, ‘‘এখানে তো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে৷ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে তাদের কেন নেয়া হলো, কী কাজে নেয়া হলো সেটা তো দেশের মানুষের কাছে ক্লিয়ার করতে হবে৷ আমরা তো এখান থেকে তাদের সেখানে তেমন কোনো কাজ দেখতে পাচ্ছি না৷''
রোখসানা খন্দকারও মনে করেন, রাষ্ট্রীয় স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে৷ ‘‘রাজনৈতিক দলের নেতা হলেও তারা রাষ্ট্রীয় কাজে গেছেন৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা রাজনৈতিক কাজ করছেন৷ তারা যেহেতু রাজনৈতিক নেতা৷ তাই তাদের কর্মী সমর্থকদের সাথে দেখা করবেনই৷ কিন্তু তাদের মূল কাজ সেটা নয়৷...আমরা মনে হয় রাজনৈতিক নেতাদের কেনো বিশেষ কারণে শেষ সময়ে সফরসঙ্গী হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷ সেটা রাজনৈতিক কারণে হতে পারে৷ ফলে, তাদের কী কাজ, তাও নির্দিষ্ট করা হয়নি,'' বলেন তিনি৷
কিভাবে বাছাই করা হলো দলগুলোকে?
বাংলাদেশে এখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৫১টি৷ এরমধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নির্বাচনী প্রতীকও স্থগিত রয়েছে৷ এনসিপি এখনও ইসিতে নিবন্ধনই পায়নি৷
এনসিপির প্রতিনিধিদের সফরে যুক্ত করায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন জাহেদ উর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা তো বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এনসিপির দুইজন প্রতিনিধিকে যদি জুলাই আন্দোলনের মুখ হিসাবেও নেয়া হয়, তাহলে তো আরো অনেকে আছেন৷ আরো রাজনৈতিক দল আছে যাদের ভূমিকা অনেক বেশি ছিলো আন্দোলনে৷ গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলো, বামপন্থই কয়েকটি দল চরম অবস্থায়ও মাঠে ছিলো৷ বিএনপি ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঘরে উঠে যায়, তখনও তারা আন্দোলনে ছিলো৷ তাহলে সেই রাজনৈতিক দলগুলো কেন এই সফরে জায়গা পেল না?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এনসিপির প্রতি বিশেষ পক্ষপাত দেখাচ্ছেন কি না সেই প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ।
রোখসানা খন্দকার মনে করেন, ‘‘তাদের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই সরকারের পক্ষপাতিত্ব দেখছি৷ আবার ড. ইউনূস হয়তো মনে করেছেন, সামনে নির্বাচন, তাই যাতে কোনো ঝামেলা না করে তাই তাদের নিয়ে গেছেন৷ কিন্তু এনসিপির দুইজন ওখানে গেলেও শাপলা প্রতীক না পেয়ে তাদের দলের লোকজন তো এখানে বসে নির্বাচন নিয়ে হুমকি দিচ্ছে৷ ফলে লাভ তো হলো না৷ তারা তো সরকারকে তাদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷''
তিনি বলেন, "প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এনসিপিকে একই কাতারে তুলে নিলেন৷ শুধু এবার না, এর আগেও আমরা বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে এনসিপিকেও ডাকতে দেখেছি৷ প্রধান উপদেষ্টা তার পদত্যাগের অভিপ্রায়ও নাহিদ ইসলামকে ডেকে বলেছিলেন৷ আর কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি৷''
জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘জাময়াত ও এনসিপি পরে তাদের আরো একজন করে প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করায় চাপ দিয়ে৷ কিন্তু অন্য কোনো দল গুরুত্ব পেল না৷ এই তিনটি দলকেই সরকার আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে৷ বিএনপি সবচেয়ে বড় দল৷ আওয়ামী লীগ না থাকায় ধরে নিলাম জামায়াত দ্বিতীয় বৃহত্তম৷ কিন্তু এনসিপি কীভাবে? এটা তো প্রশ্নের জন্ম দেয়৷
সফরে তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অন্য দলগুলোর প্রতি বৈষম্য করেছেন বলে মনে করেন রোখসানা খন্দকার৷ তিনি বলেন, ‘‘তিনি (ড. ইউনূস) কাকে সাথে নেবেন, কাকে নেবেন না সেটা তার ইচ্ছা মাফিক করছেন৷ প্রয়োজন আছে কী নাই সেটা তিনি বিবেচনা করছেন না৷ কারুর মতামত নিচ্ছেন বলে মনে হয় না৷