মঞ্জুরে খোদা টরিক: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি প্রধান স্লোগান, প্রধান রণধ্বনি ছিলো, ‘তোমার, আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’। সুতরাং যমুনা শুধু একটি নদী নয়, একটি সংগ্রাম ও একটি চেতনার নামও। ভূপেনের কণ্ঠে, ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’। ভারতের গঙ্গাই আমাদের যমুনা। আমাদের মা। সেই মায়ের আঁচলে হাত দেওয়া হবে, আর আমরা দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখবো, তা হয় না। যমুনার অববাহিকায় সিরাজগঞ্জ শহর, সিরাজগঞ্জ জেলা। আমরা দেখেছি যমুনার ভয়ঙ্কর রূপ, আবার শান্ত, স্নিগ্ধ, কমলতা। যমুনার পলি-পানিতেই ভোরে ওঠে কৃষকের গোলা, জাল ভরে ওঠে রূপালী মাছের ঝিলিক। আহ মন যমুনা, মনে পড়ে কত শৈশব-কৈশর-তারণ্যের স্মৃতি। এর অববাহিকায় জন্ম নিয়েছে কত সংগ্রামী নেতা, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, কৃতি মানুষ। যমুনা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বেঁচে থাকা ও কত না ভাঙ্গা-গড়ার স্বপ্ন-সমাধি। রবীন্দ্রনাথসহ গুনীজনদের গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাসের খোড়াক। সেই যমুনাকে ছোট করতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্ধত। গবেষণা ছাড়া বিশ্বের কোথাও নদী ছোট করার এমন তুঘলকি ইতিহাস নেই। মায়ের আঁচলে হাত, যমুনার সন্তান হিসেবে আপনি কি নির্লিপ্ত-নিরব থাকবেন?
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী ড. শ্যামল চন্দ্র দাস বলেছেন, ‘এত বড় নদীর প্রয়োজন নেই। তাই ছোট করতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নেওয়া হয়েছে। (কালবেলা ১১ মার্চ ২০২৩)’ কথিত এই পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে যমুনা নদীর প্রশস্ততা ১৫ কিলোমিটার থেকে সাড়ে ৬ কিলোমিটারে কমানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ‘যমুনা নদীর তীর রক্ষা এবং ঝুঁকি প্রশমনে টেকসই অবকাঠামো’ প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়’। নদী গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মত, এই প্রস্তাবনা বিজ্ঞানসম্মত নয়, অবাস্তব, অযৌক্তিক, গবেষণা ছাড়া এমন পরিকল্পনা সর্বনাশা। বিশ্বখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত মনে করেন, যমুনা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নদী। এর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। এই নদী অত্যন্ত ভয়ংকর। এটাকে বোঝা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এই নদীতে স্টেপ বাই স্টেপ কাজ করতে হবে। যা খুশি তা করা যাবে না। কোনো কথা নেই বার্তা নেই সাড়ে ছয় কিলোমিটার প্রশস্ততা কমানো হবে যমুনা নদী এটা মানবে না। যমুনার কাছে ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা কিছুই না, উড়ে চলে যাবে। অনুমোদন পেলেও এটা করা সহজ হবে না। কারণ যমুনা নদীর সঙ্গে ভারতও জড়িত। এটা শুরু করলেই ভারত বাধা দেবে। তিনি মনে করেন, প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে তিনি হয়তো ছুড়ে ফেলে দেবেন। শেখ রোকন মনে করেন, প্রবাহের দিক থেকেও যমুনা দেশের সবচেয়ে বড় নদী। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৪টি।
এর মধ্যে গঙ্গা, তিস্তা, বরাকসহ বাকি ৫৩টি যে পরিমাণ পানি বহন করে, ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা একাই তার চেয়ে বেশি পানি বহন করে। বাংলাদেশ অংশ ২৩০ কিলোমিটার যমুনা বা ব্রহ্মপুত্র সংকুচিত করলেন, ভারতের অংশ সেটা অবারিতই থাকল। ফলে নদীর প্রবাহ যদি অন্যদিক দিয়ে যেতে চায়, তাহলে তো মহাবিপর্যয় ঘটে যাবে। এই সর্বনাশা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কি কি ক্ষতি হতে পারে? [১] যমুনার মৎসসম্পদ, জীববৈচিত্র ও বাস্তসংস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে। [২] যমুন ব্রীজ ও রেললাইনের উপর কি প্রভাব পরতে পারে। [৩] শুধু তাই নয় পদ্মাসহ অন্যান্য স্থাপনায়ও তার প্রভাব পড়তে পারে। [৩] ভূগর্ভস্থ পানির আধার নষ্ট হতে পারে। নদী সংকোচনের ফলে অনেক এলাকায় পানিপ্রবাহ থাকবে না। [৪] ক্ষতিকর এই প্রকল্প ঋণের কারণে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাবে। [৫] এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। [৬] নদীকেন্দ্রীক অর্থনীতি, কৃষি ও জীবিকার উপর প্রভাব পড়বে। [৭] নদী সংকোচনের নামে নদী অঞ্চল দখলের বাণিজ্য চলবে। যমুনা নদী ছোট করার নামে- প্রকল্পের অর্থ অপচয় ও লুটপাটের ফন্দি রুখে দাড়ান। সিরাজগঞ্জবাসী, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ প্রেমিক, সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকে এর প্রতিবাদ করতে হবে। সরকারকে এই সর্বনাশা পরিকল্পনা বাতিলে বাধ্য করুন। লেখক ও গবেষক