বুধ ও বৃহস্পতিবার (১৯ ও ২০ নভেম্বর) পরপর দুই দিন দিল্লিতে দেখা হলো ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও ড. খলিলুর রহমানের। প্রথম দিন তাদের বৈঠক ছিল দ্বিপাক্ষিক স্তরে একান্ত আলোচনা, আর পরদিন তারা কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের (সিএসসি) মঞ্চ শেয়ার করলেন, যে বৈঠকের আয়োজক দেশ ছিল ভারত।
গত সোয়া বছরের মধ্যে এটি ছিল দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনা। কারণ গত বছরের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ সরকারের কোনও উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ভারতে কোনও সফরই করেননি, আর ভারতও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক আলোচনাতেই যাবে না।
কিন্তু পরপর কয়েকটি ঘটনার জের ধরে হালে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। ভারত মনে করছে, বাংলাদেশে সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে; ভারতে যার নিরাপত্তাগত প্রভাব পড়তে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচনের দিনক্ষণও এগিয়ে আসছে, যে নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করাটা অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে খুব বড় চ্যালেঞ্জ। এই নির্বাচন নিয়েও ভারতের একটা স্পষ্ট অবস্থান আছে, যা ঠিক বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তা ছাড়া ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অস্বস্তিকর ইস্যু তো রয়েছেই।
এই বিষয়গুলো মুখোমুখি আলোচনা করে জট খোলার প্রয়োজন আছে, সেটা অনুভব করেই কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের বৈঠকে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ভারত (নয়তো এই সম্মেলন কোনও না কোনও অজুহাতে মাস কয়েক পিছিয়ে দিলেও চলতো)। আর বাংলাদেশের দিক থেকেও এই আলোচনা শুরু করার তাগিদ ছিল বলেই তারাও এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল।
‘ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে’: ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে বর্তমানে একটা অস্বস্তি ও শীতলতা থাকলেও দোভাল-খলিলুরের আলোচনায় তা কিন্তু তেমন প্রভাব ফেলেনি। বরং আলোচনার শেষে দুই পক্ষের সূত্রগুলোই জানিয়েছে, আলোচনার সার্বিক পরিবেশ ও পরিণতি- দুটিই ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক।
ভারতের একটি শীর্ষ সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, প্রথম আলোচনাতেই এতদিনকার সব অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠা যাবে বা সব বিতর্কিত বিষয়গুলোর মীমাংসা হয়ে যাবে এটা আশা করাটা বাড়াবাড়ি। কিন্তু কূটনীতির পরিভাষায় যেটাকে বলে ‘ব্রেকিং দ্য আইস’ বা বরফ গলানোর প্রক্রিয়া, সেটা ভালভাবেই সমাধা হয়েছে।
তিনি আরও বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের ফুল এনগেজমেন্টে যে একটা বিরতির পর্ব চলছে, সেটা যে তাদের প্রতি কোনেও বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থান থেকে নয় – বরং একটা নীতিগত অবস্থান থেকে, যে একটা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গেই কেবল ভারতের পূর্ণাঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব – তা অজিত দোভাল তার কাউন্টারপার্টকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ভারত যে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং বাংলাদেশের সরকার ও সে দেশের মানুষ সেটার মর্যাদা দেয়, খলিলুর রহমান অজিত দোভালকে সেই বার্তাই দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী কার্যকলাপ?: যে পাকিস্তানের সঙ্গে মাত্র ছ’মাস আগেও ভারতের প্রায় পুরোদস্তুর একটা যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে, সেই দেশের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা যেভাবে ইদানিং ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করছেন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলছেন, তা যে ভারতের নিরাপত্তা অ্যাপারেটাসকে বিচলিত করছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপের প্রভাব পড়তে পারে বলেও দিল্লি মনে করে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রত্যাশিতভাবেই আলোচনায় এই প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন।
বাংলাদেশ তার জবাবে জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করাটা কখনোই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি নয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে যে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে কখনোই ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না, সেই আশ্বাসও দিয়েছেন খলিলুর রহমান।
নির্বাচন নিয়ে কার কী অবস্থান?: বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আছে, তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ যে নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠুভাবে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনায় ভারতকে জানানো হয়, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ এবং নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কোনও কারণ নেই, বরং খুব উৎসবমুখর পরিবেশে সারা দেশে এবারের ভোট হবে।
তবে ভারত আগাগোড়া বলে এসেছে, তারা বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চায়। যার অর্থ আওয়ামী লীগকেও ভোটে লড়ার সুযোগ দেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কেন সেটা এখন সম্ভব নয়, সেটা বাংলাদেশের দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। আর আওয়ামী লীগ যে ভোটে লড়তে পারবে না – সেই সিদ্ধান্ত যে দেশের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নিয়েছে, সরকার নয়, মনে করিয়ে দেওয়া হয় সে কথাও।
ভারত যে এই যুক্তি পুরোপুরি মেনে নিয়েছে তা বলা যাবে না। তবে দিল্লির পক্ষ থেকে এই আশ্বাস অবশ্যই দেওয়া হয়েছে যে নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, তাহলে যারা তাতে জিতে ক্ষমতায় আসবে সেই নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে ‘ডিল’ করতে বা ‘এনেগেজমেন্টে যেতে’ ভারত মানসিকভাবে প্রস্তুত। বস্তুত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক ছিল তারই প্রারম্ভিক ধাপ।
শেখ হাসিনা ইস্যুতে জটিলতা: শেখ হাসিনা যখন থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তবে থেকে দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্কে তার বিষয়টি একটি অস্বস্তির কাঁটার মতো খচখচ করছে বললেও ভুল হবে না। কিন্তু এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে, সোমবার (১৭ নভেম্বর) বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই গণহত্যার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বিষয়টি একটি আলাদা মাত্রা পেয়েছে এবং আরও জটিল আকার নিয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, জুলাই গণহত্যার বিচার সম্পন্ন করা ও শহীদ পরিবারগুলোকে ন্যায় দেওয়াটা তাদের অন্যতম প্রধান একটি ম্যান্ডেট। ফলে এই বিচারপর্ব তাদের আমলেই সম্পন্ন করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যে কারণে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য ফেলে না রেখে এই দায়িত্ব পালন করা হয়েছে এবং বিচার শেষে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত।
কিন্তু এখানে ভারতের অবস্থান সম্পূর্ণ উল্টো। তাদের ধারণা এই বিচারপ্রক্রিয়া ছিল পক্ষপাতপূর্ণ এবং এখানে অভিযুক্তরা তাদের যুক্তি তুলে ধরার সুযোগও পাননি। ট্রাইব্যুনালে এই বিচার যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে করা হয়নি, ভারত তা নিয়েও নিঃসংশয় নয়। সবচেয়ে বড় কথা, দিল্লির বিশ্বাস এই বিচারে অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। নির্বাচিত সরকারের আমলে এটা করা হলেই অনেক ভালো হতো।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে এই বিপরীত অবস্থানও অজিত দোভাল ও খলিলুর রহমানের আলোচনাতেও ছায়াপাত করেছে। এবং দুই পক্ষ যেকোনও অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছে তাও নয়। কিন্তু দুই পক্ষ একটা বিষয়ে মোটামুটি একমত হয়েছে, শেখ হাসিনাকে আপাতত আলোচনার বাইরে রেখেও আরও যেসব অমীমাংসিত দ্বিপাক্ষিক বিষয় আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা ধীরে ধীরে এগিয়ে নেওয়া যেতেই পারে।
ঠিক এই কারণেই দুই জাতীয় নিরাপত্তার উপদেষ্টার বৈঠকের পর দুই দেশের কর্মকর্তারাই একান্ত আলোচনায় বারবার বলছেন, কথাবার্তার পরিণতিও ছিল খুবই ইতিবাচক! উৎস: বাংলাট্রিবিউন।