বিবিসি বাংলা: তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচন হতে দিতে চাননি বা নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি, তারাই এখন ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে, এখনই নয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান থেকে সরে এলো কেন?
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানে আবারও পূণর্বহাল হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হচ্ছে না।
আদালতের রায় অনুযায়ী ভবিষ্যতে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে, অর্থাৎ চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই ব্যবস্থায় হতে পারে। তবে তত্ত্বাবধায় সরকার নিয়ে দিন রাজনৈতিক দলগুলোর যে অবস্থান ছিল, এখন তার পরিবর্তনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পূণর্বহালের বিষয়ে যে রিভিউ আবেদনে করেছে, সেখানেও ভবিষ্যতের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়া হয়। এই অবস্থানকে ‘রহস্যজনক’ বলেই মনে করছেন অনেকে।
বিএনপি এবং জামায়াতের আইনজীবীরা অবশ্য বলছেন, আইনের যে ধারাগুলো সংবিধানে সংযোজনের কথা বলা হয়েছে সেগুলো সংসদ ছাড়া সম্ভব নয়। এ কারণেই এগুলো করার আগে একটি সংসদ প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে রিভিউ আবেদনকারী এক পক্ষের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলছেন, এই মুহূর্তে সংসদ না থাকায় নিয়ম অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনেরও সুযোগ নেই।
কারণ আইন অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন দেবে তত্ত্ববধায়ক সরকার। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটি সম্ভব নয়, বলেন তিনি।
যদিও এটিকে ‘হালকা যুক্তি’ বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। তার মতে, আইনগত অবস্থান থেকে সরে গেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
পক্ষে-বিপক্ষে যেসব যুক্তি
ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়–– এই দাবিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন শুরু করেছিল বিরোধী দলগুলো।
যে আন্দোলনের মুখে একই বছর সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিক রূপ পেয়েছিল।
কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই, ২০১১ সালের ১০মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। ‘অগণতান্ত্রিক’ এবং ‘সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ বলে বাতিল করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
এরপর থেকেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা পূণর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দাবিতে সোচ্চার থাকতে দেখা গেছে।
কিন্তু এই দলগুলোর পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আপিল বিভাগে যে রিভিউ আবেদন করা হয়েছিল সেখানে প্রোসপেকটিভ বা ভবিষ্যতের জন্য উল্লেখ করা হয়।
বিএনপির ভাইস চেয়ারমান ও এই মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলছেন, যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বে রয়েছে এবং তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে, সেই কারণেই ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন তারাও।
তার মতে, যে আর্টিকেলগুলো পুনস্থাপন বা সংশোধনের কথা আদালত বলেছেন সেগুলো তো এই সরকার করতে পারবেন না।
এক্ষেত্রে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের সময়ের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করছেন তিনি। এইচ এম এরশাদের সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ওই নির্বাচন একটি অনানুষ্ঠানিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হয়েছিল।
‘১৯৯১ সালের ওই নির্বাচনে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না, তারপরও তিনি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন।’
এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যাতে কোনো বিতর্ক তৈরি না হয় সেই বিষয়টি আদালতই পরিষ্কার করে দিয়েছেন বলে মনে করেন জামায়াতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির।
তিনি বলছেন, ‘অনলি প্রোসপেকটিভলি বা কেবল ভবিষ্যতের জন্য, বিতর্ক এড়ানোর জন্যই এই লাইনটুকু অ্যাড করা হয়েছে। যেন এটা নিয়ে আমরা এখনই বিতর্ক না করি। তাহলে বর্তমান সরকার থাকবে কি থাকবে না, কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট এখনই হবে কি হবে না এটি আপিল বিভাগ ক্লিয়ার করে দিয়েছেন।’
বিএনপি এবং জামায়াতের এমন অবস্থান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, রিভিউ আবেদনের যুক্তিতর্কের ওপর ভিত্তি করেই আদালত রায় দেন।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলছেন, দলগুলো যদি এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইতো তাহলে আদালতও তার ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নিতেন।
মোরশেদ বলছেন, ‘ওনারা সবাই যখন এক হয়ে গেছে যে তত্ত্বাবধায়ক হোক, কিন্তু এখন না পরে হোক। সেভাবেই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়েছে। কোর্ট তার ওপর ভিত্তি করেই রায় দিয়েছে।
রায় নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পূণর্বহালের রায়কে যুগান্তকারী হিসেবে উল্লেখ করছে রাজনৈতিক দলগুলো। এই রায়ের মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চার পথ আরও শক্তিশালী হবে বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
কিন্তু এই রায়ের পর, আপিল বিভাগের রায় পরিবর্তনে বিতর্ক হবে কি না, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ইস্যুর সঙ্গে এই রায় সাংঘর্ষিক হয় কি না এমন নানা প্রশ্ন সামনে আসছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা সামনে আসার পরই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। তবে এই রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল এবং নেক্সট পার্লামেন্টে ডিজল্ভ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে এটি কার্যকর হবে।
আপিল বিভাগ তার আগের রায়কেই ত্রুটিপূর্ণ বলছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলেই আগের রায় বাতিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এই রায় লেখার ক্ষেত্রে বিচারপতি খাইরুল হক এবং তার সহযোগীরা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারায় অপরাধ করেছেন।
এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আদালতের আগের রায় রিভিউয়ের মাধ্যমে পরিবর্তন হওয়ায় ভবিষ্যতেও এই রায় একইভাবে পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে কি না?
এক্ষেত্রে অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর আগের রায় রিভিউয়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পূণর্বহাল হওয়ায় এক্ষেত্রে আর রিভিউয়ের সুযোগ থাকলো না।
‘এটা এখন পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড চ্যাপ্টার, কারণ সেকেন্ড রিভিউ আমাদের আইনে পারমিট করে না,’ বলেন তিনি। তবে অন্য কোনা রায়ের ওপর আলাদা ফাইন্ডিংয়ে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের ওপর আদালতের রায় নির্ভর করে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, ‘কোন রায় পক্ষপাতদুষ্ট এবং কোন রায় আইনি ব্যাখ্যায় মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে, ভোটাধিকার রক্ষা করবে সেটা জাতি বিবেচনা করবে।’
আদালত সর্বসম্মতিক্রমে আগের রায় বাতিল করেছেন, আগামী সংসদ ডিজল্ভ হওয়ার পর থেকে এই রায় কার্যকর হবে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং সাংবিধানিক বলে ঘোষিত হলো–– জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
‘এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন, দিনের ভোট রাতে হবে না,’ বলেন তিনি।
এছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের বিচারাধীন ইস্যু এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পূণর্বহালের যে রায় আদালত দিয়েছে, দুটি বিষয় সাংঘর্ষিক হওয়ার সুযোগ আছে কি না এমন প্রশ্নও উঠেছে।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, ‘কোনো ক্ল্যাশের (সংঘর্ষের) প্রশ্নই ওঠে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছিল, এটি আলাদা ইস্যু’।
তিনি বলছেন, এই সংশোধনীটা আনাই হয়েছিল অসৎ উদ্দেশ্যে। এছাড়া এ বিষয়ে যদি কোনো আপিল হয় তাহলে ‘অ্যাপিলেট ডিভিসন রিভিউ করতে গেলে এই রায়টাকে সব সময় সুপারসিড (প্রতিস্থাপন) করতে হবে’।