এল আর বাদল : আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের আসন নিশ্চিত করতে কোনো কসুর ছাড়তে নারাজ ক্ষমতাসীন বিজেপি।
সে কথা মাথায় রেখেই অনুপ্রবেশ ইস্যু, দুর্নীতি এবং ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর নিয়ে বিরোধিতার অভিযোগ তুলে তৃণমূল কংগ্রেসকে বিঁধলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
নদীয়ার তাহেরপুরে একসভায় অডিওবার্তা মারফত তিনি অভিযোগ করেন, তৃণমূল তাকে 'গোব্যাক' বলতে ব্যস্ত কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের ইস্যুতে রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকার নীরব থাকে। ----- সূত্র, বিবিসি বাংলা
প্রধানমন্ত্রী জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি দেখেছেন- তাহেরপুরে তার সভায় যাওয়ার পথে 'গোব্যাক মোদী' লেখা পোস্টার লাগানো রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল "ভোট ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের সে কথা বলে না, বরং তাদের বাঁচাতে এসআইআরের বিরোধিতা করে"।
মি. মোদী বলেছেন, আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লক্ষ্য করেছি সভায় আসার পথে বোর্ডে লেখা রয়েছে গোব্যাক মোদী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা গলিতে, প্রতিটা পোস্টে এটা লেখা থাকলে ভালো হতো- গোব্যাক অনুপ্রবেশকারী।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এরা গোব্যাক মোদীর স্লোগান দেয় কিন্তু এরা গোব্যাক অনুপ্রবেশকারী বলে না…এরা সেই অনুপ্রবেশকারী যারা রাজ্যে কব্জা করেছে। তৃণমূল এদেরকেই পছন্দ করে। এটাই তাদের আসল চেহারা।"
নদীয়ার এই অঞ্চল এবং উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরের মতো এলাকা মতুয়া সম্প্রদায় অধ্যুষিত। সদ্য প্রকাশিত এসআইআর-এর তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত অঞ্চল থেকে নাম বাদ যাওয়ার তথ্য মিলেছে, তার মধ্যে মতুয়া অধ্যুষিত বেশ কিছু এলাকাও রয়েছে। সেই নিয়ে মতুয়াদের মধ্যে উদ্বেগও রয়েছে।
সেই আবহে মতুয়া অধ্যুষিত এই এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর সভার গুরুত্ব ছিল। সকলের চোখ ছিল তিনি কী বার্তা দেন, তার উপর।
প্রসঙ্গত ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর নিয়ে প্রথম থেকেই বিরোধিতা জানিয়ে এসেছে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের অভিযোগ ছিল, এসআইআর-এর নামে মুসলিমদের নিশানা করতে চায় বিজেপি।
বামপন্থি দলগুলোও এসআইআর প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেছে। এদিকে, চলতি সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনে প্রায় ৫৮ লাখ ভোটারের নাম বাদ পড়েছে। খসড়া তালিকাও প্রকাশ রেছে।
প্রধানমন্ত্রীর শনিবারের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে তৃণমূল। তার তোলা অনুপ্রবেশ ইস্যুকে পাল্টা হাতিয়ার করে সমালোচনাও করেছে।
দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, "বিজেপি এসআইআর-এর মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে যে মানুষের নাম বাদ দেওয়ার কাজ করেছে তাতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় জন্মেছে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সে নিয়ে কিছু বললেন না।
কী বলেছেন প্রধানমন্ত্রী?
আগামী বছরের বিধানসভা ভোটকে 'পাখির চোখ' করে বিজেপিসহ সমস্ত রাজনৈতিক দলই এখন সক্রিয়। বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গ যে গেরুয়া শিবিরকে যে বিজেপি লক্ষ্য করছে, সে কথা প্রধানমন্ত্রী মোদী বিহারের ভোটের পরপরই স্পষ্ট করেছিলেন।
কথা ছিল, তাহেরপুর পুরসভা সংলগ্ন নেতাজি হাইস্কুলের মাঠে সকালে তিনি জনসভা করবেন। তার আগে প্রশাসনিক বৈঠক করারও কথা ছিল।
আসন্ন ভোটের আগে মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে এই জনসভা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ এসআইআর-এ এই এলাকায় অনেক ভোটারের নাম বাদ গিয়েছে।
তার সভার আগে রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার বলেছিলেন, "তিন দেশ থেকে যারা অমুসলিম এসেছে কারও ভোটাধিকার বাদ যাবে না, এটা আমার বিশ্বাস। আর সেটা নিশ্চিত করবেন বলেই মোদী জি আসছেন", যদিও সে প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।
শনিবার ঘন কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতার অভাবে তার চপার অবতরণ করতে পারেনি, তাই তাহেরপুরের সভায় তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি কলকাতা ফিরে এসে অডিও বার্তা পাঠান।
সভায় উপস্থিত না হতে পারায় ক্ষমাপ্রার্থনা করে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেন। এই সভায় যোগ দিতে আসা কয়েকজন বিজেপি কর্মীদের ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন।
তার ভাষণে একদিকে যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চৈতন্যদেবের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, তেমনই নদীয়া ও মতুয়া সম্প্রদায়ের নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ''নদীয়া সেই ভূমি, যেখানে প্রেম, করুণা, ভক্তির রূপ হিসেবে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়েছে। নদিয়ার গ্রামে গ্রামে কীর্তনের সুর উঠত, ঐক্যের সুর বাজত। সেই ভাবনা এখনো বিরাজমান বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একবার সুযোগ দিন
তার বক্তব্যে তৃণমূলকে কটাক্ষ করেছেন প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গে অরাজকতা চলছে বলে অভিযোগ তুলেছেন।
তিনি বলেছেন, ''বিহারে জঙ্গলরাজ উপড়ে দিয়েছে বিজেপি। ২০ বছর পরেও বিজেপিকে আগের থেকে বেশি আসন পেয়েছে।"
"পশ্চিমবঙ্গে মহাজঙ্গলরাজ চলছে। এর থেকে মুক্তি দরকার।"
কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপি সরকারের 'ডবল ইঞ্জিন সরকার' গঠনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি। মি. মোদী বলেছেন, ''বিজেপিকে একটা সুযোগ দিন। ডবল ইঞ্জিন সরকার গড়তে দিন, দেখুন কত দ্রুত এখানে উন্নয়ন হয়।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অন্যান্য বিজেপি নেতা
তাহেরপুরের সভাতে দাড়িয়েই শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেছেন, "আমি মোদীজি কে ধন্যবাদ দিতে চাই, যারা বাংলাদেশ থেকে ধর্মরক্ষার জন্য ভারতে এসেছেন তাদের জন্য সিএএ এনেছেন। এই তৃণমূল এবং তার নেত্রী মমতা ব্যানার্জী একে ক্যা ক্যা ছি ছি বলেছেন। মোদীজি শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় গ্যারেন্টার।"
"আপনারা দেখেছেন দীপু দাসের (ময়মনসিংহে যাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে) উপর বাংলাদেশে যে অত্যাচার হয়েছে, আপনারা এর বিরুদ্ধে যারা সনাতনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে জামাতিদের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে, নদীয়াকে রক্ষা করবেন। আমি আপনাদের কাছে এই অনুরোধ করছে চাই।"
একই সুর শোনা গিয়েছে শমীক ভট্টাচার্যের কণ্ঠে। তিনি বলেছেন, "পশ্চিমবঙকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানাতে দেওয়া যাবে না।"
"ওপারে হিন্দুদের উপর নির্মম অত্যাচার চলেছে। ওপারে যে মতুয়া ভাইরা আছেন, দত্ত, বোস, দত্ত, গুপ্ত… চাকমা, বুদ্ধিস্ট রয়েছেন তারা আমাদের রক্ত আমাদের ভাই। যারা ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় চলে এসেছেন তাদের তুলসি মঞ্চে প্রদীপ জ্বালাবেন বলে, নিজেদের পদবী টিকিয়ে রাখবেন বলে, তাদের পাশে যদি কোনো দল থেকে তাহলে সেটা বিজেপি।
বিরোধীরা কী বলছে?
নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছে তৃণমূল ও বামেরা।
তৃণমূলের কুণাল ঘোষ বলেছেন, "প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ একেবারেই দিশাহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন।"
বিজেপি প্রভাবিত নির্বাচন কমিশনের এসআইআর নামক হঠকারিতায় যারা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছেন, তাদের জন্য বার্তা দিতে পারতেন। কিন্তু তার কাছে কোনো বার্তা নেই।"
তার মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন বাম নেতা সুজন চক্রবর্তীও। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলে সাংবাদিকদের বলেছেন, "এসআইআরে যাদের নাম অন্যায়ভাবে বাদ গিয়েছে তাদের বিষয়ে তিনি কিছু বললেন না। যাদের অন্যায়ভাবে অনুপ্রবেশকারী বলে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের বিষয়ে কিছু বললেন না।