মহসিন কবির: জুলাই-আগস্টে সারা দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ভূমিকা নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। নিরস্ত্র মানুষের পুলিশ ওপর গুলি চালিয়েছিল, একালেন জনগনের সঙ্গে দূরত্ব বেশি বেড়েছে। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
এই অবস্থায় সেবা গ্রহণে নাগরিকদের সমস্যা ও অভিযোগ শোনার জন্য সব সরকারি দপ্তরে নির্দিষ্ট বিরতিতে গণশুনানি নিশ্চিতের সুপারিশ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নে গত ২৮ জুলাই পুলিশের সব রেঞ্জ ডিআইজি, মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং সব জেলার পুলিশ সুপারকে ‘ওপেন হাউস ডে’ আলোচনাসভা শুরু করতে নির্দেশ দেয় পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে জনগণের সঙ্গে পুলিশের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটি কমিয়ে আনতে ‘ওপেন হাউস ডে’ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকের অপব্যবহারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হবে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নেও এই উদ্যোগ কাজে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কিংবা এর পূর্বে পুলিশের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে জনগণের দূরত্ব প্রশমিত করার জন্য উন্মুক্ত দিবসের আলোচনা কর্মসূচি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে পুলিশের কাছে জনগণের প্রত্যাশা, পুলিশ সংস্কারের ধরন এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ও তৎপরতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতামত শোনা ও গ্রহণের সুযোগ থাকবে। যা পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কগত দূরত্ব কিংবা অনাস্থার পরিধি অনেকাংশে সহনশীল হবে।
জানা গেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০০৭ সালে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার নাইম আহমেদ রাজধানীর থানাগুলোয় ‘ওপেন হাউস ডে’ কর্মসূচি চালু করেন। তার সেই উদ্যোগ ভালো ফল দেওয়ায় সারাদেশে এটি চালু করে পুলিশ সদর দপ্তর। তখন এই কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য ছিল অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এলাকার জনগণের সঙ্গে পুলিশের এক হয়ে কাজ করা। ওপেন হাউস ডে অনুষ্ঠানে উপস্থিত এলাকাবাসী প্রকাশ্যে নিজ নিজ এলাকার আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ পরিস্থিতির বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য তুলে ধরতেন। পাশাপাশি মৌখিক এবং লিখিত অভিযোগ দিতেন। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্থানীয় থানা পুলিশ পদক্ষেপ গ্রহণ করত। এতে জনগণের সঙ্গে পুলিশের একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এলাকার যে কোনো ঘটনার খবর পুলিশ তাৎক্ষণিক পেয়ে যেত। তড়িত ব্যবস্থা নিয়ে যে কোনো অপরাধের ঘটনা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওপেন হাউস ডে অনুষ্ঠানে মেট্রোপলিটন এলাকায় ডেপুটি পুলিশ কমিশনার/অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার/সহকারী পুলিশ কমিশনার উপস্থিত থাকেন। আর জেলাগুলোতে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত অংশ নেন। এতে খোলামেলা আলোচনা করেন এলাকাবাসী। ফলে থানা পুলিশের সেবার বিষয়ে সরাসরি ধারণা লাভ করেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) মো. রবিউল হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে আমরা ওপেন হাউস ডে সভা শুরু করেছি। এর মাধ্যমে আমরা পুলিশ ও জনগণের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে চাই। একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চাই। জনগণের সহযোগিতা পেলে সামাজিক অপরাধ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। জনগণের কাছ থেকে আমরা নানা তথ্য পেতে পারি। এ জন্য এলাকাভিত্তিক নাগরিক কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এক সময় ওপেন হাউস ডে সভা আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখত। সভায় সমাজের অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রাধান্য থাকত। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে সভায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। এতে ওপেন হাউস ডে সভা লক্ষ্য হারাতে শুরু করে। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর এই সভা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব কমাতে সবশেষ এ বছরের পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে সারাদেশে উন্মুক্ত সভা করার প্রস্তাব আসে। পরে গত ২৮ জুলাই সারাদেশে আবার ওপেন হাউস ডে সভা করার নির্দেশনা প্রদান করে পুলিশ সদর দপ্তর। এরপরই সারাদেশে এই সভা শুরু হয়। এ জন্য থানায় থানায় নাগরিক কমিটি গঠন করা হচ্ছে।