প্রযুক্তি ডেস্ক: আজকের ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট ছাড়া এক মুহূর্তও কল্পনা করা কঠিন। অফিসের জরুরি মিটিং, সন্তানের অনলাইন ক্লাস থেকে শুরু করে পরিবারের বিনোদন—সবকিছুই এখন ইন্টারনেট-নির্ভর। নিরবচ্ছিন্ন ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এখন রয়েছে ওয়াই-ফাই রাউটার। কিন্তু অনেকেই অভিযোগ করেন, ভালো প্যাকেজ কেনা সত্ত্বেও ইন্টারনেটের গতি কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। এর পেছনে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের (ISP) দুর্বলতা নয়, বরং আপনার নিজের করা একটি সাধারণ ভুলই দায়ী হতে পারে—আর তা হলো রাউটারের ভুল অবস্থান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াই-ফাই সিগন্যাল হলো এক ধরনের রেডিও তরঙ্গ, যা দেয়াল, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে সহজেই বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। তাই রাউটারটি সঠিক জায়গায় স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি।
ওয়াই-ফাই রাউটার একটি কেন্দ্রবিন্দু থেকে চারদিকে ৩৬০ ডিগ্রিতে সিগন্যাল পাঠায়, অনেকটা পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেভাবে। যদি রাউটারটিকে ঘরের এক কোণায় রাখা হয়, তবে এর সিগন্যালের একটি বড় অংশ বাড়ির বাইরে চলে যায়, যা সম্পূর্ণ অপচয়। ফলে ঘরের অন্য প্রান্তের ডিভাইসগুলো দুর্বল সিগন্যাল পায় এবং ইন্টারনেটের গতি কমে যায়।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা কিছু নির্দিষ্ট স্থানকে ওয়াই-ফাই রাউটারের জন্য ‘নিষিদ্ধ অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই জায়গাগুলো এড়িয়ে চললে ইন্টারনেটের গতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
১. ঘরের কোণ বা বেসমেন্টে: রাউটার ঘরের কোণায় রাখলে সিগন্যালের প্রায় অর্ধেক শক্তি দেয়ালের বাইরে চলে যায়। একইভাবে, বেসমেন্টে রাখলে পুরু কংক্রিটের ছাদ ভেদ করে সিগন্যাল ওপরের তলায় পৌঁছাতে পারে না, ফলে সংযোগ অত্যন্ত দুর্বল হয়।
২. পুরু দেয়াল ও ধাতব বস্তুর পাশে: কংক্রিটের দেয়াল, ইটের গাঁথুনি, রেফ্রিজারেটর, ধাতব আলমারি বা বড় আয়নার মতো বস্তুগুলো ওয়াই-ফাই সিগন্যাল শোষণ করে বা প্রতিফলিত করে ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। রান্নাঘরে রাউটার রাখা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কারণ সেখানে ধাতব যন্ত্রপাতির আধিক্য থাকে।
৩. অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির কাছে: মাইক্রোওয়েভ ওভেন, কর্ডলেস ফোন, ব্লুটুথ স্পিকার এমনকি কিছু মনিটরও ২.৪ গিগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে, যা বেশিরভাগ রাউটারের ডিফল্ট ফ্রিকোয়েন্সি। এই ডিভাইসগুলোর কাছাকাছি রাউটার থাকলে সিগন্যাল একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় (Signal Interference), যার ফলে ওয়াই-ফাই সংযোগ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
৪. বন্ধ ক্যাবিনেট, ড্রয়ার বা আলমারির ভিতরে: অনেকেই বাড়ির সৌন্দর্য রক্ষার জন্য রাউটারকে লোকচক্ষুর আড়ালে, যেমন—টিভি ক্যাবিনেট বা বন্ধ আলমারির ভেতর রাখেন। এটি একটি মারাত্মক ভুল। কারণ এতে সিগন্যাল কাঠের বা প্লাস্টিকের দরজায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর পাশাপাশি, বদ্ধ জায়গায় রাউটার অতিরিক্ত গরম হয়ে যেতে পারে, যা এর কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে যন্ত্রের ক্ষতি করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামান্য কিছু নিয়ম মেনে চললেই রাউটারের কার্যকারিতা বহুগুণে বাড়ানো যায়।
বাড়ির কেন্দ্রীয় ও খোলা জায়গা: রাউটারটিকে বাড়ির যথাসম্ভব মাঝখানে স্থাপন করুন। এমন একটি স্থান বেছে নিন যেখান থেকে সব ঘরে সিগন্যাল প্রায় সমানভাবে পৌঁছাতে পারে। বসার ঘর বা ড্রয়িংরুম সাধারণত এর জন্য আদর্শ।
মাটি থেকে উঁচুতে: রাউটারের সিগন্যাল কিছুটা নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। তাই এটিকে মেঝেতে না রেখে টেবিল, বুকশেলফ বা দেয়ালের মাউন্টে অন্তত ৪-৫ ফুট উঁচুতে স্থাপন করুন। এতে সিগন্যাল আসবাবপত্রের বাধা এড়িয়ে সহজে ছড়াতে পারবে।
কম বাধা-বিপত্তিযুক্ত স্থান: রাউটার এবং আপনার ব্যবহৃত ডিভাইসগুলোর মধ্যে যত কম দেয়াল বা বাধা থাকবে, সংযোগ তত ভালো হবে। চেষ্টা করুন রাউটারটিকে ‘লাইন অফ সাইট’ বা দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখতে।
অ্যান্টেনা সঠিকভাবে সাজান: যদি আপনার রাউটারে একাধিক অ্যান্টেনা থাকে, তবে সবগুলো একদিকে না রেখে একটিকে উল্লম্ব (Vertical) এবং অন্যটিকে অনুভূমিকভাবে (Horizontal) রাখুন। এতে বিভিন্ন অবস্থানে থাকা ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের রিসিভারের সাথে সংযোগ ভালো হয়।
শেষ কথা:
ইন্টারনেটের গতি নিয়ে হতাশ হয়ে সার্ভিস প্রোভাইডারকে ফোন করার আগে বা নতুন রাউটার কেনার কথা ভাবার আগে, আপনার বর্তমান রাউটারের অবস্থানটি একবার পরীক্ষা করে দেখুন। উপরে উল্লিখিত নিয়মগুলো অনুসরণ করে এর জায়গা পরিবর্তন করলেই হয়তো আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই ছোট পরিবর্তন আপনার ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে আরও স্থিতিশীল ও আনন্দদায়ক করে তুলবে।
সূত্র:
১. প্রযুক্তি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম CNET এবং PCMag-এর একাধিক প্রতিবেদন।
২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন (FCC) কর্তৃক প্রকাশিত ওয়াই-ফাই সংযোগ উন্নত করার নির্দেশিকা।
৩. বিভিন্ন রাউটার প্রস্তুতকারক সংস্থা (যেমন: TP-Link, Netgear, Asus) কর্তৃক প্রকাশিত সেরা অনুশীলন (Best Practices) সংক্রান্ত তথ্য।