পুরো শহরটা যেন ছেয়ে গিয়েছিল ঘন কালো অন্ধকারে! কে দেখে বুঝবে ঘড়ির কাঁটায় তখন মাত্র বিকেল সাড়ে চারটা। চারদিকের আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধেয়ে আসছে কালবৈশাখী। খানিক বাদেই মেঘ ডেকে আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি।
টানা এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে অনেককে যেমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে, বিপরীতে নভেম্বরে এই বৃষ্টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উচ্ছ্বাসও করতে দেখা গেছে অনেককে।
পঞ্জিকার পাতায় ইংরেজি নভেম্বর মাসের শুরুটাই আজ শনিবার। যে কারণে বিকেল থেকে এই বৃষ্টির ছবি তুলে অনেককে ফেসবুকে পোস্ট করে লিখতে দেখা গেছে- নভেম্বর রেইন।
শহরের কারো কারো এই বৃষ্টি নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও নভেম্বরের ভারি বৃষ্টিপাত যে ফসলের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে সেটিকে বেশ দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবেও দেখছেন কৃষিবিদরা।
তারা বলছেন, এই মৌসুমে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হলে সেটি কখনো কখনো ফসলের জন্য উপকারী। কিন্তু এমন ভারি বৃষ্টিপাত কিংবা টানা বৃষ্টি শীতকালীন ফসলসহ কৃষিতে খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী পাঁচ দিনও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "অক্টোবর ও নভেম্বরে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ তৈরি হলে সেগুলো শক্তি অর্জন করে এবং এর প্রভাবে বাংলাদেশ-ভারত কিংবা মিয়ানমার অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে মেঘমালা তৈরি অব্যাহত থাকে। যার ফলে কখনো কখনো হালকা, কখনো ভারি বা কখনো মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়"।
শেষ বিকেলে হঠাৎ এই বৃষ্টিতে নগরীতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এর ফলে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় তীব্র যানজটও তৈরি হয়।
একটানা ভারি বৃষ্টির সতর্কবার্তা
আবহাওয়ার এমন পরিস্থিতির মধ্যেই শনিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বুলেটিনে আগামী চব্বিশ ঘণ্টায় ঢাকাসহ তিনটি বিভাগে ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ বিহার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে লঘু চাপ আকারে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের পশ্চিমাংশজুড়ে অবস্থান করছে।
এর প্রভাবে শনিবার সন্ধ্যা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বাংলাদেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর এই দুই মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ তৈরি হয়। কখনো কখনো তা গভীর নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়েও রূপ নেয়। এটি যখন উপকূল অতিক্রম করে তখন বাংলাদেশ বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় সারি সারি মেঘমালা হয়, দমকা হাওয়া হয়, দমকা ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারি বৃষ্টিপাতও হয়ে থাকে সাধারণত"।
যে কারণে ভারি ও টানা বৃষ্টিপাতের শঙ্কা থাকলেও শনিবারের বৃষ্টিপাতকে খুব একটা অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন না আবহাওয়াবিদরা।
মি. মল্লিক বলছিলেন, "আজকের ঢাকাসহ সারাদেশে যে বৃষ্টি হয়েছে এটা ভারি বৃষ্টিপাত, তবে স্বাভাবিক। এই পূর্বাভাস আগেই দিয়েছিল আবহাওয়া অফিস"।
এমন অবস্থার মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় আবহাওয়া অফিস টানা পাঁচ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে- রোববার থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও খুলনা বিভাগের দু'এক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে সারাদেশের কোথাও কোথাও মাঝারী ধরনের ভারি বর্ষণ হতে পারে।
সোমবার বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
মঙ্গলবার- বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও ময়মনসিংহ বিভাগের দু'এক জায়গায় বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
এছাড়া বুধবার খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দু'এক জায়গায় বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এরপরই আস্তে আস্তে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমতে পারে বলেও বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ভারি বৃষ্টিতে দুর্ভোগ ও ভোগান্তি
এর আগে শনিবার সকালটা রৌদ্রজ্জ্বল থাকলেও একটু একটু করে মেঘ জমতে থাকে দুপুরে। বিকেল ৪টা নাগাদ ঢাকার আকাশ ঢেকে যায় কালো মেঘে। এরপর সাড়ে চারটা নাগাদ শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
বিকেল পাঁচটার পর বাড়তে থাকে বৃষ্টি। সেই এই বৃষ্টি একটানা অব্যাহত থাকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। এরপরই কমতে শুরু করে বৃষ্টিপাত।
প্রায় একটানা আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ অলিগলি পানিতে তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো রাস্তায় তৈরি হয় জলাবদ্ধতা।
এই ভারি বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে শহরের কোথাও কোথাও দেখা দেয় তীব্র যানজট। সব মিলিয়ে অফিসফেরত সাধারণ মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে।
দিনের শুরুতে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া দেখে ছাতা ছাড়াই বেশিরভাগ মানুষ বের হয়েছিলেন কর্মস্থলে। কিন্তু অফিস শেষে বৃষ্টির কারণে অনেককে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
বৃষ্টির মধ্যে সিএনজি, রিকশা কিংবা অটোরিকশায়ও বাড়তি ভাড়া দিয়ে অনেককে চলতে হয়েছে।
বেসরকারি চাকরীজীবী মঞ্জুরুল আহসান ঢাকার পল্টনের অফিস শেষ করে বাসায় যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলেও বৃষ্টির কারণে বের হতে পারেননি। পরে যখন সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হন তখন সিএনজি বা অটোরিকশা কিছুই পাচ্ছিলেন না।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, অন্যদিন পল্টন থেকে রামপুরা পর্যন্ত দেড়শ টাকা সর্বোচ্চ ভাড়া দিয়ে থাকেন তিনি। শনিবার সন্ধ্যার পর বেশিরভাগ সিএনজি অটোরিকশা সেই ভাড়া হাঁকছিলেন সাড়ে তিনশো থেকে চারশো টাকা পর্যন্ত।
ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা
বছরের এই সময়ে সাধারণত আমনের চাষাবাদ হয়ে থাকে। শনিবার বিকেল থেকে কখনো ভারি কখনো হালকা বৃষ্টিপাত চলে একটানা দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে।
বাংলাদেশে নভেম্বর ও ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারি অর্থাৎ শীতের দিকে ধানসহ শীতকালীন নানা সবজি চাষাবাদ হয়ে থাকে।
এই সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হলে সেটি সাধারণত ফসলের জন্য খুব একটা ক্ষতির কারণ হয় না বলে মনে করেন কৃষিবিদরা।
কৃষিবিদ তালহা জুবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেন, "যদি এই বৃষ্টিপাত অল্প হতো সেটা জমি কিংবা ফসলের জন্য উপকারী ছিল। কিন্তু শনিবার যে বৃষ্টি হয়েছে সেটা তো ভয়াবহ বৃষ্টি। নভেম্বরে তো এমন বৃষ্টি আমরা সাধারণত দেখি না"।
কৃষিবিদরা বলছেন, এই ধরনের ভারি বৃষ্টিপাত হলে অনেক ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে করে যে সব ফসলের মূল মাটির নিচে থাকে সেগুলো বেশিরভাগ সময় নষ্ট হয়ে যায়।
মি. জুবায়ের বলছিলেন, "আজকে যে ভারি বৃষ্টি হয়েছে কাল থেকে যদি আবার রোদ ওঠে তখন অনেক সময় এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। আর যদি এই বৃষ্টি একটানা দুই তিন দিন বা আরো সময় ধরে চলতে থাকে তাহলে তা ফসলের জন্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হতে পারে"।
এই মৌসুমে সাধারণত মাঠে ধান থাকে। কৃষকদের কেউ কেউ আবার ধান কেটে কেবল মাঠে রেখেছে মাত্র। এমন সময় ভারি কিংবা টানা বৃষ্টি ধানের বড়সড় ক্ষতি করতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা।
কৃষিবিদ মি. জুবায়ের বলছিলেন, "অনেক মানুষের জমিতে এখনো ধান রয়েছে। অনেকে ধান কেটে জমিতে রেখেছে। এরকম মুষলধারে বৃষ্টি ধানের জন্য বড় ক্ষতি। কারণ টানা বৃষ্টি হলে ধানগুলো ভেজা থাকবে। আবার যে সব ধান এখনো কাটা হয়নি সেগুলোর অনেক ফসল মাটির সাথে মিশে যেতে পারে"।
সূত্র: বিবিসি নিউস বাংলা