সংবিধানের আওতায় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট যতগুলো আইন আছে তার মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত মূল আইনটির নাম গণপ্রতিনিধিত্ব আইন বা Representation of the People Order সংক্ষেপে যাকে বলা হয় আরপিও (RPO)।
১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশের সংবিধান তৈরির পর নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রথমবারের মতো আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ প্রণয়ন করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে এ আইনে। সবশেষ ২০২৩ সালে সংসদে পাস হয় গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আইন ২০২৩।
নির্বাচনের জন্য দেশের মানুষের গণঅধিকার কোনগুলো এবং এ অধিকার রক্ষায় নির্বাচন কমিশন কী করবে সে সবই আরপিওতে উল্লেখ আছে। কীভাবে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে- তাও এর মধ্যে বলা আছে।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। তার আগে নির্বাচন সংক্রান্ত আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
গত ২৩ অক্টোবর বেশ কিছু বিধান যুক্ত করে নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করে উপদেষ্টা পরিষদ। এটি এখন রাষ্ট্রপতির সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে।
ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে সংশোধিত আরপিওর নানা দিক তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে হবে।
এ পরিবর্তনের ফলে জোটে থাকলেই প্রার্থীদের দলীয় প্রতীকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ- বিএনপির জোট শরিকরা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না।
উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের মতো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিন বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না।
এ ছাড়া পলাতক আসামিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না রাখা, প্রার্থীদের দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদের বিবরণী দেয়া বাধ্যতামূলক করা, কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রাখা, কোনো সংসদীয় আসনে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বন্ধে কমিশনকে ক্ষমতা দেয়া, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার–সম্পর্কিত বিধান বিলুপ্ত, ৫০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা বা অনুদান ব্যাংকে লেনদেনসহ আরও বেশি কিছু সংশোধনী আছে অনুমোদিত খসড়ায়।
ধারাগুলোর মধ্যে হলফনামায় বিদেশে সম্পদের উল্লেখ করা, সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা, আদালত ঘোষিত পলাতক আসামিকে নির্বাচনের অযোগ্য করা, ৫০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা বা অনুদান ব্যাংকে লেনদেনের বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি কেউ আপত্তি করেনি।
তবে, জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও নিজেদের প্রতীকে ভোটে অংশ নেয়ার বিধান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপিসহ কিছু দল।
সংশোধিত আরপিওতে জোটভুক্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার যে বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে তা তুলে নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবেদনটি তার হতে তুলে দেয়ার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,
আরপিওর ২০ ধারায় কেবিনেটে একটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। আগে বিধান ছিল জোটভুক্ত দলগুলো হয় নিজেদের প্রতীক অথবা জোটের অন্য কোনো দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে।... আরপিওতে অনেকগুলো সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশোধনীর প্রায় প্রতিটির সঙ্গে আমরা একমত হয়েছি। তবে এই বিধানটার সঙ্গে একমত নই।
এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনেও চিঠি দিয়েছে বিএনপি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে চিঠি পৌঁছে দিয়ে তার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, ‘জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করা কিংবা নির্বাচন করার অধিকার থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছে অনুযায়ী নিজ দল কিংবা জোটের যে কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করাও গণতান্ত্রিক অধিকার। সে অধিকার ক্ষুণ্ন করার কোনো সুযোগ আছে বলে বিএনপি মনে করে না। তাই আমরা আরপিওতে ২০ অনুচ্ছেদের পূর্বের বিধান বহাল রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছি।’
এদিকে জামায়াত বলেছে, বিএনপির দাবিতে জোট শরিককে দলীয় প্রতীক দেয়ার নিয়ম পুনর্বহাল করে আরপিও সংশোধন করা হলে তারা সেটি মানবে না। জুলাই সনদসহ কয়েকটি ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধের মধ্যেই শনিবার প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে ভিডিও বার্তায় জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘গত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এর আগের সপ্তাহে গৃহীত আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া একটি দলের অযৌক্তিক দাবির কাছে নতি স্বীকারের শামিল।’
ইতিপূর্বে নির্বাচন কমিশন ও উপদেষ্টা পরিষদ উভয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রতিটি দল নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেবে। জামায়াত সেই সিদ্ধান্তের পক্ষেই আছে, জাতিও একমত। এর পরিবর্তন হলে এর বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ হবে।
আরপিও'র ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি)। রোববার দলটির পক্ষ থেকে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের পাঠানো চিঠিতে জামায়াতের মতো ‘একই সুরে’ বার্তা দেয়া হয়েছে।
এনসিপির চিঠিতে বলা হয়, ‘২০০৮ সালে আরপিও-তে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ সংশোধনী আনা হয় যে সুযোগে বহু ছোট বা নামমাত্র দল বড় দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হয়েছেন। সর্বোপরি জনগণকে ধোঁকা দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে তাকে ঐতিহাসিক ও নীতিগতভাবে সঠিক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন নাহিদ। একই সঙ্গে কমিশনের গৃহীত এবং উপদেষ্টা পরিষদে পাস হওয়া আরপিও’র অনুচ্ছেদ ২০ এর সংশোধনী অনুযায়ী গেজেট প্রকাশের দাবি জানান তিনি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও তীব্র বিরোধ
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য ছিল। তবে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ জমা দেয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য তীব্রভাবে সামনে এসেছে।
সুপারিশ জমা দেয়ার পর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি বলছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন অযৌক্তিক বলেও মনে করে দলটি। তারা এটি কোনোভাবেই মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটসহ পাঁচ দাবিতে আন্দোলন করছে জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি দল। আর এনসিপি জানিয়েছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ দেখার পরই তারা সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
গত মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের দেয়া সুপারিশে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী জাতীয় সংসদই সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। এটি ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। তবে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন নাকি তার আগেই আয়োজন করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন।
বিএনপি জানিয়েছে, তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন কোনোভাবেই মেনে নেবে না। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরেই গণভোট চায়।
এদিকে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘এখন গণভোট নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত মুখোমুখি অবস্থানে আছে। আমরা দুই দলের কাছে আহ্বান রাখবো, আপনাদের এ ধরনের যুদ্ধ নির্বাচনকে ব্যাহত করবে, নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দুই দলকে আহ্বান জানাবো, নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না।’
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। উৎস: সময়নিউজটিভি।