বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে সাম্প্রতিক উদ্বেগ ও কিছু ব্যাংকের দুর্বল আর্থিক অবস্থার খবরের পর সাধারণ আমানতকারীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে—তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে কতটা নিরাপদ? একসময় মানুষ মাটির ব্যাংকে বা সিন্দুকে টাকা রাখলেও এখনকার যুগে ব্যাংকই প্রধান ভরসা। কিন্তু সব ব্যাংক কি সমান নিরাপদ? সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৯টিই রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ‘রেড জোনে’। এই পরিস্থিতিতে টাকা রাখার জন্য সঠিক ও নিরাপদ ব্যাংক বেছে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথম আলোর একটি ভিডিও প্রতিবেদনে ভালো ব্যাংক চেনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে।
গ্রাহকবান্ধব ও আধুনিক ব্যাংকিং সেবা:
একটি ভালো ব্যাংক চেনার প্রথম শর্ত হলো এর গ্রাহকসেবার মান যাচাই করা। কেবল সুদের হার বেশি হলেই একটি ব্যাংক ভালো হয় না। ব্যাংকটি কতটা গ্রাহকবান্ধব, তা বোঝা যায় এর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে। ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা এবং দেশব্যাপী এটিএম নেটওয়ার্ক কতটা উন্নত ও সহজলভ্য, তা যাচাই করা প্রয়োজন। এসব সুবিধা গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে ব্যাংকের আন্তরিকতার পরিচায়ক।
গ্রাহক অভিযোগ ও সেবার মান:
কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগের হার কেমন, তা তার সেবার মান বোঝার একটি বড় উপায়। যদি একটি ব্যাংক সম্পর্কে গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার অভিযোগ ওঠে, তবে বুঝতে হবে সেখানে গ্রাহক সন্তুষ্টির হার কম। যে ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম, সেই ব্যাংকে টাকা রাখা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
উচ্চ মুনাফার প্রলোভন থেকে সাবধান:
কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়লে সাধারণ গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে অস্বাভাবিক উচ্চ মুনাফার লোভ দেখায়। এই ধরনের প্রলোভনে পা দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যাংক গ্রাহকের প্রয়োজনের সময় টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হতে পারে। তাই কোনো ব্যাংকের মুনাফার হার বাস্তবসম্মত কি না, তা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
খেলাপি ঋণ একটি বড় বিপদসংকেত:
একটি ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য বোঝার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো খেলাপি ঋণের (Non-Performing Loan বা NPL) হার। সাধারণত, ভালো ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বেশি, সেই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। টাকা রাখার আগে পছন্দের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সর্বশেষ তথ্য জেনে নেওয়া আবশ্যক।
এডিআর (ADR) এবং অন্যান্য সূচক:
ব্যাংকের Advance to Deposit Ratio (ADR) বা আমানতের বিপরীতে ঋণের অনুপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামি ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। কোনো ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করলে বুঝতে হবে তাদের ঋণ নীতিতে ঝুঁকি রয়েছে।
তথ্য যাচাই ও সতর্কতা:
যেকোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। এছাড়া, গুগল বা অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ব্যাংকের নাম লিখে অনুসন্ধান করলে সাম্প্রতিক তথ্য ও গ্রাহকদের মতামত পাওয়া যায়। আগে ক্রেডিট রেটিং বা ‘ক্যামেলস রেটিং’ দেখে ব্যাংক বাছাই করা হলেও এখন অনেক দুর্বল ব্যাংকও কৌশলে ভালো রেটিং পেয়ে যাচ্ছে। তাই কেবল রেটিংয়ের ওপর ভরসা না করে বাস্তব পরিসংখ্যান ও তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শেষ কথা:
আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের নিরাপত্তা আপনার একটি সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তাই যেকোনো ব্যাংকে টাকা রাখার আগে এর সার্বিক আর্থিক স্বাস্থ্য, গ্রাহকসেবার মান, খেলাপি ঋণের হার এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা যাচাই করে নিন। আপনার সচেতনতাই হতে পারে আপনার সঞ্চয়ের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।