ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ একটি নীরব ঘাতক, যা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করছে। এটি এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যা সময়মতো শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ না করা হলে শরীরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয় এবং হৃদরোগ, কিডনি বিকল হওয়া, অন্ধত্বসহ বিভিন্ন মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। এই রোগে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না অথবা উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়। তবে আমাদের শরীর প্রায়শই কিছু সতর্ক সংকেত পাঠায়, যা এই রোগের পূর্বাভাস দেয়। এই লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে প্রাথমিক অবস্থাতেই রোগটি ধরে ফেলা সম্ভব। নিচে ডায়াবেটিসের ৭টি প্রধান প্রাথমিক লক্ষণ আলোচনা করা হলো, যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ ও রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত।
১. ঘন ঘন প্রস্রাব (Polyuria)
ডায়াবেটিসের অন্যতম সাধারণ এবং প্রাথমিক লক্ষণ হলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিবার প্রস্রাবের বেগ আসা, বিশেষ করে রাতের বেলায়। রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে কিডনি সেই অতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য দ্বিগুণ কাজ শুরু করে। এর ফলে মূত্রের উৎপাদন বেড়ে যায় এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন হয়।
২. অতিরিক্ত তৃষ্ণা (Polydipsia)
ঘন ঘন প্রস্রাবের ফলে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বেরিয়ে যায়, যা ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা তৈরি করে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য মস্তিষ্ক বারবার পানি পানের সংকেত পাঠায়। ফলে অস্বাভাবিক এবং অতৃপ্ত এক তৃষ্ণার অনুভূতি হয়, যা পানি পান করার পরেও সহজে মেটে না।
৩. অস্বাভাবিক ক্ষুধা (Polyphagia)
পর্যাপ্ত খাবার খাওয়ার পরেও যদি আপনার ক্ষুধা না মেটে এবং বারবার খেতে ইচ্ছে করে, তবে এটি ডায়াবেটিসের লক্ষণ হতে পারে। ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় শরীরের কোষগুলো রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ গ্রহণ করে শক্তি উৎপাদন করতে পারে না। ফলে কোষগুলো "ক্ষুধার্ত" থাকে এবং মস্তিষ্ককে আরও খাবারের জন্য সংকেত পাঠায়।
৪. শারীরিক ক্লান্তি ও দুর্বলতা
রাতে পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরেও যদি সারাদিন ধরে শরীর ক্লান্ত ও দুর্বল লাগে, তবে তা অবহেলা করবেন না। কোষগুলো যখন শক্তি তৈরির জন্য পর্যাপ্ত গ্লুকোজ পায় না, তখন শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এর ফলে দৈনন্দিন সাধারণ কাজকর্মেও অনীহা ও ক্লান্তি চলে আসে।
৫. দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে বা কমে গেলে তা চোখের লেন্সের ওপর প্রভাব ফেলে। এর ফলে লেন্স সংকুচিত বা প্রসারিত হতে পারে, যা দৃষ্টিশক্তিকে সাময়িকভাবে ঝাপসা করে দেয়। যদিও রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে এলে এই সমস্যা ঠিক হয়ে যায়, তবে ঘন ঘন এমনটা হলে তা ডায়াবেটিসের স্পষ্ট ইঙ্গিত হতে পারে।
৬. ত্বক শুষ্ক হওয়া ও ত্বকে গাঢ় দাগ পড়া
ডায়াবেটিসের কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়লে ত্বক তার স্বাভাবিক আর্দ্রতা হারায় এবং শুষ্ক ও খসখসে হয়ে পড়ে। এছাড়া, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের কারণে অনেকের ঘাড়, বগল, কুঁচকি এবং শরীরের অন্যান্য ভাঁজে গাঢ় মখমলের মতো দাগ দেখা যায়, যাকে মেডিকেলের ভাষায় অ্যাকানথোসিস নিগ্রিকানস (Acanthosis Nigricans) বলা হয়। এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাস।
৭. ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া
রক্তে উচ্চ মাত্রার শর্করা শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। এর ফলে শরীরের কোথাও কেটে গেলে বা ক্ষত তৈরি হলে তা সহজে শুকাতে চায় না এবং সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
উপরে উল্লিখিত লক্ষণগুলোর এক বা একাধিক যদি আপনার শরীরে প্রকাশ পায়, তবে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন এবং রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করিয়ে নিন। প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়।
সূত্র: এই প্রতিবেদনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন (ADA), এবং মায়ো ক্লিনিক (Mayo Clinic) ও ওয়েবএমডি (WebMD)-এর মতো আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।