শায়লা সিমি নূর: দিনকয়েক ধরে ইন্টারনেটে একটা ছবি ঘুরছে। ছবিতে এক নারী একটি কার্ড ধরে রয়েছেন। তাতে লেখা ‘আমি এক পুত্রসন্তানকে বড় করছি, যার সঙ্গে আপনার কন্যাসন্তান নিরাপদ।’ মা-সন্তানের বন্ধন অত্যন্ত শক্তিশালী। এ সম্পর্ক স্বয়ং আল্লাহ্পাক স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন এবং রহমত নিরবিচ্ছিন্ন রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। এ সম্পর্ক পৃথিবীর সব সম্পর্ককে মহিমান্বিত করেছে। কখনো উল্টোও ঘটছে। ঘটছে মা তার সদ্যজাত সন্তানকে ফেলে যাওয়ার ঘটনাও। সংক্ষিপ্তাকারে ভারতীয় একটি গল্প এরকম-‘কন্যাসন্তান জন্ম নেয়ায় মা তাকে আমগাছের নিচে ফেলে যান। এ শিশু আম্রপালি বা আমরূপালী নামে বড় হয়। নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে তাকে সাধক হিসেবে অঙ্কন করে। আম্রপালি সৃষ্টিকর্তার দাসী হয়ে যান।’ মূল আলোচনায় ফিরি। ছবি ধরে রাখা মা এবং যে মায়েরা ভাবছেন যে সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়বেন, তারা কিভাবে সে পথে এগোবেন?
স্বার্থ বর্জিত সত্যিকারের প্রেম কী?
যদি সত্যপ্রেমের কথা বলি, তা কেবল সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিরাজমান। এ থেকেই আমাদের প্রাপ্তি। মানুষকে ভালোবেসে হাজারও খাদ্য তার সৃষ্টি। এগুলো গ্রহণের উপায়ও বাতলেছেন। আমাদের ব্যবহার করা সার্চ বা রিসার্চ শব্দ কিছু অর্জনের একটি পদ্ধতিগত জ্ঞান। আল্লাহ্পাক শুধু মানুষ মায়েরা নন, সমস্ত জীবের মায়ের অন্তরে ভালোবাসার বীজ বপন করেছেন। এটা তাকে অর্জন করতে হচ্ছে না। মা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সন্তানকে ভালোবেসে যান। এমনকি মায়ের রূহ সন্তানের মঙ্গল কামনায় থাকে। আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের বা কোনো সংগঠনের সদস্য ও নাগরিক হিসেবেও বাঁচতে হয়। আমাদের সামাজিক আঙ্গিক ধর্ষণরোধে বা নারী ও শিশুর সঙ্গে আচরণের বিচারে কতখানি সুষ্ঠু?
সমাধান হিসেবে হতে পারে মা তার ছেলেকে নারীদের সন্মানরক্ষার উপায় শিক্ষা দিলেন। হতে পারে মা সন্তানকে সংসারে মেয়েদের সহযোগিতায় সম্পৃক্তকরণের মধ্যে দিয়ে নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে গড়ে তুললেন। হতে পারে বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকে নারীর সঙ্গে আচরণ বিষয়ে কোনো অনুশীলন সংযুক্ত করা হলো। আরও নানা উপায় থাকতে পারে। যেমন- বাবাকে মায়ের সঙ্গে আচরণ পরিবর্তনে আইন প্রণয়ন করা। অর্থাৎ প্রত্যেককে এ বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তোলা। সম্পূর্ণভাবে নারীর ওপর যৌনহয়রানি ও অন্যান্য নির্যাতন বন্ধ প্রক্রিয়াটির পর্যায়ক্রমিক নিরন্তর ফলাফলের জন্য কাজ করা, পরিকল্পনা গ্রহণ করা। কিন্তু সব পরিবারের পারিবারিক সংস্কৃতি, মনোভাব, আকাঙ্খা এক নয়। কারো পরিবারে কন্যা সন্তানকে ঘরের কাজ না শিখিয়ে ক্রীড়া সংক্রান্ত শিক্ষা দেয়াই গুরুত্ব পেতে পারে। আবার কোনো পরিবারে ছেলে-মেয়ের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে পারে বিজ্ঞান শিক্ষা। অভিভাবকের সকল মনোযোগ ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উপার্জনক্ষম হওয়া। কিন্তু উপার্জন হালাল হবে কিভাবে! সঠিক আচরণ শিক্ষা দেয়া, সৎ উপদেশ দেয়া, সৎ চরিত্রবান করে সন্তানকে গড়ে তোলার ওপর কয়টা পরিবার গুরুত্বারোপ করে? এসবের ওপর থেকে মনোযোগ সরে যাচ্ছে অভিভাবকদের এবং শিক্ষকদেরও।
সুষ্ঠ আচরণ এবং শুভকামনা
উত্তেজনা একটি শক্তি বা এনার্জি। এনার্জির কোনো নিদিষ্ট রূপ নেই। এটাকে যেকোন দিকে পরিবর্তন করা যায়। মননের শিক্ষা দিয়ে সমাজ পরিবর্তনে কাজে লাগানো যায়। কিছু বিষয়ে আশপাশের মানুষের তথ্যকে উপেক্ষা করতে হয়। কিছু বিষয় পরিবর্তনের চেষ্টা না করে তা উপেক্ষার মধ্যে দিয়ে ভালো থাকে। যেমন গাছ জন্মে থাকলে বাড়ির আঙ্গিনায় তাকে নিজের মতো বাড়তে দিতে হয়। খুব বেশি কিছু করতে চাইলে পানি বা সার দেয়া। কোনো সৃষ্টি আল্লাহ্পাক কারণ ছাড়া করেন না। গাছ যেখানে জন্মেছে তা কোনো উদ্দেশ্যে হয়েছে। যে জন্মগ্রহণ করেছে মেয়ে বা ছেলে সন্তান হোক, তার কিছু কার্য-কারণ রয়েছে। তার ওপর যদি সমাজ বা পরিবার কোনো উদ্দেশ্য চাপিয়ে দেয়ও, যদি দেখা যায় যে তার মতামত ভিন্ন, শিশুর মননকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে প্রকৃতির মতো বেড়ে উঠতে দিতে হবে। তারপরও মানুষের মাঝে সৎ বা অসৎ থাকবেই। শুভকামনা শুধু জন্মদিন বা বিয়েতে নয় সর্বক্ষণ শুভকামনা ও আল্লাহর রহমের দোআ ঘরে ঘরে বিরাজমান থাকলে উত্তেজনা থেকে সৃষ্ট শক্তিসমূহ নম্র হয়ে যোগাত্মক উপায়ে ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত হবে। যেমন আম্ফান ঝড়ের ক্ষেত্রে অনেকেই বলেছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সমস্ত রাত্রি মোনাজাতে ছিলেন; যে কারণে বাংলাদেশ কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
নারী ও পুরুষের পর্দা কী?
নারী-পুরুষের ওপর অর্থাৎ মানুষের ওপর আব্রু বা পর্দা আবশ্যক। আল্লাহ্পাকের নবী ও আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.) যখন স্বর্গে ছিলেন; আল্লাহ্পাক তাদের রুহানি পর্দায় রাখেন। এক সময় তাদের মধ্যে যখন জগতের লজ্জা ও ভয়ের ধারণা জাগ্রত হয়, তাদের পর্দার জন্য বস্ত্রের প্রয়োজন হয়। সাধকরা যারা আল্লাহর তরফ হতে জ্ঞানী, তারা জানেন, কাপড়ের সঙ্গে দ্বীন এর সম্পর্ক রয়েছে। একই সঙ্গে চোখের আচরণের এমনকি শব্দের এবং সমস্ত অঙ্গের ও অনুভূতির পর্দা রক্ষা করা প্রয়োজন হয়। এতে করে বিরাজমান শক্তিসমূহ এমনকি আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতেও নম্রতা বিরাজ করে। পর্দার সঠিক আকারও জানার বিষয় রয়েছে। আচরণের, বসনের ও চরিত্রের শালীনতাই পর্দা।
অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট।
সুতারং আমরা উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে আধুনিকায়নের চেষ্টা করছি। সেখানে কিছু ঠিক ও ভুল আছে। বেশিরভাগ গ্রামকে শহরায়ন করা হয়েছে ভ্রান্ত আকারে। এখানে সম্পৃক্ত সংস্থা ও সংগঠনও বেশিরভাগ সময় দেখা যায় বাংলাদেশের নয়, বিদেশি সংস্থা অথবা ভারতীয় সংস্থা, যাদের আমাদের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন নিয়ে বিশেষ এক ধরণের ধারণা আছে যা গবেষণা চালিয়ে কয়েক মাসে তারা পেয়েছেন বা কিছু তথ্য প্রশাসনের গবেষণার ফলাফল হিসেবে তারা কাগজপত্রে পেয়েছেন। এর সঙ্গে বাস্তবের মিল বা ও অমিল কতখানি তা পরিষ্কার নয়। আকর্ষিক একটি জীবনবোধ থেকে অন্য একটি জীবনবোধে লাফ দিয়ে চলে গেলে পা ভেঙে যেতে পারে! তো সেভাবেই ভেঙে যাচ্ছে আমাদের মনন, এমন কি ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে আমাদের জলবায়ু, কৃষি ক্ষেত্র, শিক্ষা ব্যবস্থা, নদী ও প্রকৃতি। কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতো , এখনো পারে। চাষ-আবাদের মধ্যে দিয়ে এ দেশে কৃষি নির্ভর সুষম অর্থনীতি করে তুলতে পারে।
আধুনিক বা উন্নত শব্দটি ব্যবহার প্রয়োজনীতা ফুরিয়ে গেছে এখন। এসব শব্দ দিয়ে তেমন কোনো উপকার হবে না কোনো সমাজের। বিভিন্ন সংস্থা এসবের মধ্যে দিয়ে আমাদের মৌলিকত্ব কেনা-বেচা করছে। এসব শব্দের বাইরে এমন ভাবনার জাতি তৈরি করা দরকার। যার আকাঙ্খা সঠিক ও নির্ধারিত, ভবিষ্যৎ সন্তানদের কথা বলছি। এ সকল বিষয় যখন মা-বাবা বুঝবেন তখন জিপি এ পাওয়া বা গাড়ি-বাড়ি চড়া নিয়ে সন্তানকে চাপ দেবেন না। তখন মেয়ে সন্তানটি তার গন্তব্য জানবে। আর ছেলে সন্তানও তার ওপর নিহিত সামাজিক অস্থিরতা ও অতিরিক্ত চাহিদার ভার থেকে মুক্ত থাকবেন। এ প্রক্রিয়ায় মানুষ আল্লাহ্পাকের বলে দেয়া পথেই আলোর সন্ধান পাবে। যেমন ধরুন- প্রতিবেশীর প্রতি যে দায়িত্ব ছিল তা না পালন করার ফলে পরিবারের সন্তানরা প্রতিবেশী মেয়েটির সঙ্গে ভাইবোনের মতো কখনই মিশতে পারবে না। তার ক্ষতিতে কখনই আপনার সন্তানের মন কাঁদবে না। এ প্রক্রিয়াতে সন্তান আমলা হন বা রাজনৈতিক তার কোনো কাজ নৈতিকতা বর্জিত হবে না।
অকাজ বউড়ী দড়, লাউ কুটতে খরতর
সন্তানদের দায়িত্ব শুধু মা নিজের কাঁধে নিলে তা ভুল সিদ্ধান্ত হবে। নিজের কাঁধ ভারি করে অভিভাবক শুধুমাত্র জটিল জীবন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করছেন তাই নয়, সন্তানের চাহিদা পূরণ ও লোক-দেখানো প্রতিষ্ঠার আখাঙ্খা ভুল পথে পরিচালিত করবে অভিভাবকেও। সন্তান সম্প্রদায়ের বা সমাজের সম্পদ, আল্লাহ্পাক তাকে উপর্যুপরি একটি উদ্দেশ্যে কল্যাণের স্বার্থে প্রেরণ করেছেন। উপার্জন নিয়ে ও হালাল উপার্জন নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.), যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী... ইরশাদ করেন, ‘ফরজ ইবাদতসমূহের (নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরজ এবং ইবাদতের গুরুত্ব রাখে।
আপনার শরীর ও মননের যে জৈবিক সম্পর্ক রয়েছে; যে প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠ রাখে হালাল উপার্জন। দান, সাদাকা ও সঠিক যাকাত প্রদানের মধ্যে দিয়ে নানা শারীরিক ও সামাজিক নিরাপত্তা আল্লাহ তারিফ থেকে আদায় করে নেয়া যায়।
`দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য’ এ নীতিতে চলতে হবে
আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনোই জ্ঞান নেই; নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩২)। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)–এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানব “আলাক” থেকে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সুরা-৯৬ আলাক, আয়াত: ১-৫)। ‘দয়াময় রহমান (আল্লাহ)! কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণনা শেখালেন।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত ১-৪)। সমাজ সেবা বা শিক্ষকতা একটি পেশা বর্তমানে। পেশা যখন শিক্ষা প্রদান তখন অবশ্যই বেঁচে নিতে হবে সেই মানুষগুলোকে যারা আদর্শবান ও সৎ এবং আল্লাহর জ্ঞানে আলোকিত।
পবিত্র কোরআন, হাদিসের সঠিক শিক্ষাকে অন্তরে জাগ্রত করতে হলে আল্লাহর প্রেমকে বুঝতে হবে। আল্লাহর প্রেম ও শাসন সকলই মানুষের প্রয়োজনে বলে দেওয়া পাথেয় , বিকল্পে কল্প- কথা ও নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধিপাবে।
লেখন পরিচিতি : সুফী শিল্পী ও কবি। বেগম রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড গ্যালারি, বেগম প্রকাশনা, বেগম অ্যানিম্যাল কেয়ার, রাজুস রিড লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী।