সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশের রাজনীতিতে এক কিংবদন্তি। তিনি আপসহীন নেত্রী নামে পরিচিত। তার রাজনৈতিক উত্থান ও সংগ্রামের ইতিহাস দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা স্বৈরাচারী সরকারের শাসনামলে চরম দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, মামলার জটিলতা এবং সরকারি নিষেধাজ্ঞা শিকার হন খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। তার সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রতিরোধকে আটকে দেওয়া হয়।
তবে বাধা পেরিয়ে ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার দেওয়া সেই জ্বালাময়ী ভাষণ এবং জনসভাটি মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘শেষ জনসভা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সেই প্রকাশ্য সমাবেশে দেয়া তার জ্বালাময়ী বক্তব্যের পর আর কোনো জনসভায় উপস্থিত হতে দেয়া হয়নি তাকে। এটি বিএনপি ও সমমনা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কাছে ছিল স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে খালেদা জিয়াকে কার্যত জনসমাবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। সেই তিন বছর বিএনপি বারবার জনসভা ও র্যালির অনুমতি চাইলেও প্রশাসনের নানা শর্ত, নিষেধাজ্ঞা, স্থানের পরিবর্তন বা হঠাৎ বাতিল করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্তের কারণে কোনো ধরনের জনসভায় উপস্থিত হতে পারেননি তিনি। সেই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভাটি ছিল তার রাজনৈতিক ময়দানে ফের দাপুটে প্রত্যাবর্তন, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির জন্যে তাৎপর্যপূর্ণ দিন।
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেই জনসমাবেশে বেলা ৩টায় যোগ দেন খালেদা জিয়া। সেদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে জনসমাগম, কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সব বাধা অতিক্রম করে খালেদা জিয়া সেদিন মঞ্চে দাঁড়ান এবং সেই বক্তব্য হয়ে ওঠে তার শেষ বড় গণসমাবেশ।
খালেদা জিয়ার ভাষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সরকারি দলের দমন-পীড়ন। তিনি সরাসরি ঘোষণা করেন-‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’ দাবি তোলেন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন এবং সেনাবাহিনীকে ভোটের সময় মাঠে রাখা। তিনি শেখ হাসিনার সরকারকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন ‘একদলীয় শাসন কায়েম’ এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ‘রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দমন-পীড়ন চালানোর’ জন্য।
ভাষণের কিছু অংশ ছিল অত্যন্ত জ্বালাময়ী, যা তখনকার কয়েকটি সংবাদমাধ্যম তুলে ধরতে পারলেও অনেকেই এড়িয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়, স্বাধীনতা চায় এবং বিএনপি সেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে।’ তার সেই দৃঢ় অবস্থান ও চ্যালেঞ্জমূলক বক্তব্য সমাবেশকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। এরপর শাসকগোষ্ঠীর তীব্র রোষানল আর নীরব এক দীর্ঘ রাজনৈতিক অন্ধকারে ফেলে দেয়া হয় তাকে। এই সমাবেশের পর বিএনপি বহুবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে খালেদা জিয়ার জনসভা আয়োজনের চেষ্টা করলেও প্রশাসন কোনো অনুমতি দেয়নি। বিভিন্ন সময় পুলিশের ব্যারিকেড, নিষেধাজ্ঞা, অনির্দিষ্ট নিরাপত্তা-হুমকি বা রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে সভা বাতিল করা হয়। খালেদা জিয়াকে এরপর আর কখনো জনসমাবেশে বক্তব্য দিতে দেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) বেগম খালেদা জিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার যে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন রাজপথ, গণমিছিল আর জনসভায় বলিষ্ট হয়ে উঠেছিল, সেই যাত্রায় শেষ জনসভা হয়ে থাকবে ২০১৭ সালের সেই দিনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণসমাবেশ। সে দিন তিনি যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, তা যেন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। উৎস: নিউজ২৪