মো. হাবিবুল আলম : দেশের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন শফিউল আলম। কয়েকজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সমবায় সমিতির মাধ্যমে একটি গাড়ি কিনেছেন, যা মূলত পণ্য পরিবহণে ব্যবহার হয়। এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ার খবর শুনেছেন তিনি। হাসিমুখে বললেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ে হলে দ্রুততম সময়ে ও তুলনামূলক কম খরচে পণ্য পরিবহণ করা যাবে, যা ভবিষ্যতে আমাদের সমিতির জন্য অধিকতর মুনাফা আনবে বলে মনে করি।’
এক্সপ্রেসওয়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে প্রধান মহাসড়কে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার হলে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, যা একটি এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে অর্জন করা সম্ভব।’
বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ তথা দেশের সার্বিক উন্নয়নে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার বিকল্প নেই। গত কয়েক বছরে সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে জুনে। এ বছরই চালু হচ্ছে মেট্রোরেল ও কর্ণফুলি টানেল। যানজট কমাতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশও খুলবে চলতি বছর। এসব প্রকল্পের পাশাপাশি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করতে ৮টি নতুন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মেগা পরিকল্পনা করছে সরকার। এসব প্রকল্প ২০৪১ সালের মধ্যে চালু হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী যোগাযোগ গড়ে তুলতে সমুদ্রবন্দর ও কয়েকটি স্থলবন্দরকে যুক্ত করবে এসব সড়ক। দেশের প্রথম ও একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের মতো নতুন এক্সপ্রেসওয়েগুলো থেকেও সাধারণ জনগণ, পরিবহণ ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি দেশ সার্বিকভাবে উপকৃত হবেÑএমন ধারণা প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসওয়ে
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের তথ্যমতে, ৫টি এক্সপ্রেসওয়ে দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য নির্মিত হবে এবং বাকি ৩টি পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে ৪ লেনের ২২৫২ কিলোমিটার সড়ক। এখানে শুধু দূরপাল্লার যাত্রী ও মালবাহী যানবাহন টোল প্রদানকারী এক্সপ্রেসওয়েগুলো ব্যবহার করার অনুমতি পাবে।
সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর থেকে কক্সবাজারের গুনদুম পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। এটি চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরকেও সংযুক্ত করবে। ময়মনসিংহের গোবরাকুড়া স্থলবন্দর থেকে আরেকটি এক্সপ্রেসওয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় দুইভাগে বিভক্ত হবে। একটি যাবে মোংলা বন্দর এবং অন্যটি পায়রা বন্দরে। এই এক্সপ্রেসওয়ের জন্য মানিকগঞ্জ-রাজবাড়ী পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর থেকে এক্সপ্রেসওয়েটি নীলফামারীর জলঢাকায় দুইভাগে বিভক্ত হবে। একটি পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের দিকে এবং অন্যটি লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরের দিকে। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিমে, বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে কুমিল্লার লাকসাম পর্যন্ত একটি এক্সপ্রেসওয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চাঁদপুর-শরীয়তপুর পয়েন্টে মেঘনা নদীর ওপর একটি সেতুসহ তামাবিল-গুনদুম এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। আরেকটি এক্সপ্রেসওয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তামাবিল-গুনদুম এক্সপ্রেসওয়েকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের সঙ্গে যুক্ত করবে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতুসহ তামাবিল থেকে জয়পুরহাট পর্যন্ত আরও একটি এক্সপ্রেসওয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এক্সপ্রেসওয়ে
আটটি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু হতে পারে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিনউল্লাহ নুরীর সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত বৈঠক হয়েছে। সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ বলছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর চাপ বেড়ে গেছে বহুগুণ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশই রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে পরিচিত চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে।
দেশের প্রধান এ দুই নগরীকে যুক্ত করেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এ মহাসড়কের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হয়। মহাসড়কটিতে বর্তমানে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করায় নতুন করে এই মহাসড়কটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে খুবই জরুরি। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেক দ্রুত বাড়ছে। ফলে মহাসড়কটির সক্ষমতা কমেছে।
বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ এশিয়ার কিছু দেশ দেরিতে হলেও ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক সংযোগের জন্য রাস্তা ও মহাসড়ক নির্মাণের ওপর জোর দিয়েছে। এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নির্মিত একমাত্র বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ব্যয় প্রতি কিলোমিটার ছিল ২০০ কোটি টাকা। এই গণনা থেকে প্রস্তাবিত ২২৫২ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বর্তমান বাজারমূল্যে মোট ব্যয় হবে ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
এক্সপ্রেসওয়ের এই বিশাল নেটওয়ার্ক নির্মাণে অর্থায়ন একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, ভবিষ্যতে এ পথই হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি। এক্সপ্রেসওয়েগুলো যেমন ঢাকার যানজট এড়িয়ে দূরপাল্লার যানবাহনকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর অনুমতি দেবে, এটি রাজধানীতেও যানবাহনের চাপ কমাবে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চিত যে ৫৪৫ কিলোমিটার তামাবিল-গুনদুম এক্সপ্রেসওয়ে ব্যাবসাবাণিজ্যের সম্প্রসারণে ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হবে।
বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসওয়ের অর্থনৈতিক সুবিধা সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুল হক বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বের দেশগুলো ব্যয়-সুবিধার বিষয়টির চেয়ে কৌশলগত কারণে বেশি গুরুত্ব দেয়। ‘ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ বিবেচনায় নেওয়া হলে অস্ট্রেলিয়ায় অনেক এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হতো না। এর কারণ, ৩০ মিনিটের মধ্যেও দেশের কিছু এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো গাড়ি দেখা যায় না।’
শুরুতে দুবাইয়ের মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো তাদের খরচের তুলনায় সামান্য সুবিধা পেয়েছিল, এই তথ্য দিয়ে ড. শামসুল হক বলেন, তখন এই শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫৫ লাখ, তাই অবিলম্বে সুবিধা পাওয়ার আশা ছিল না। কিন্তু এখন দুবাইয়ে জনসংখ্যার তুলনায় সাতগুণ বেশি পর্যটক। তারা এখন সুপরিকল্পিত মেট্রো প্রকল্পের সুফল ভোগ করছে।’
উন্নত দেশগুলো রাজ্যের অখণ্ডতা, এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক সংযোগ এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন বিবেচনায় নিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব এক্সপ্রেসওয়ে কোনো দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে না। বুড়িমারী-ভোমরা এক্সপ্রেসওয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সহজ যোগাযোগের সুবিধা দেবে। এটি প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজতর করবে। এক্সপ্রেসওয়েটি এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের যোগাযোগ সহজতর করবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ ধরনের এক্সপ্রেসওয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য উপকৃত হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ জোরদার করতে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থে এই এক্সপ্রেসওয়েগুলো নির্মাণ করা দরকার। আঞ্চলিক সংযোগ বিবেচনায় নেওয়া হলে সব এক্সপ্রেসওয়ে একই অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসবে না, কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায়, দীর্ঘ মেয়াদে সব এক্সপ্রেসওয়ে থেকে দেশ লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও কিছু এক্সপ্রেসওয়ের লক্ষ্য আঞ্চলিক সংযোগ স্থাপন দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব হবে না, তারা বাণিজ্যের পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে।’ পিআইবি ফিচার
মো. হাবিবুল আলম, ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক