শিরোনাম
◈ আরপিও ২০ ধারার সংশোধনী: রাজনৈতিক অধিকার বনাম আইনগত বাধ্যবাধকতা ◈ পাঁচ দুর্বল ইসলামী ব্যাংক একীভূত: নতুন ‘সম্মিলিত ব্যাংক’ গঠনের পথে সুযোগ ও ঝুঁকি ◈ নৌ, বস্ত্র ও পাট, পরিকল্পনা ও সমবায়ে নতুন সচিব ◈ যারা চাপে পড়বেন নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হলে ◈ প্রার্থীদের ঋণতথ্য যাচাইয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ◈ জাকির নায়েকের বাংলাদেশে আসা নিয়ে যা বললেন ধর্ম উপদেষ্টা (ভিডিও) ◈ সাংবাদিককে কনুই মারলেন বিএনপি নেতা সালাম, ভিডিও ভাইরাল ◈ বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা ইস্যুতে যে পদক্ষেপ নিল ভারতীয় দূতাবাস ◈ গণভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে সোমবার! ◈ দুর্দান্ত ব‌্যা‌টিং‌য়ে অঙ্কনের শতক, ঘুরে দাঁড়ালো ঢাকা বিভাগ 

প্রকাশিত : ০২ নভেম্বর, ২০২৫, ০৯:০৭ সকাল
আপডেট : ০৩ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কেন বাংলাদেশ ছাড়ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান পিঅ্যান্ডজি

বিশ্বের যেসব উচ্চ সুনামধারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যক্তি পরিচয়কে আড়ালে রেখে সব সময় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যের পরিচয় ও সেসবের গুণগত মানের বিষয়টিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক কম্পানি প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল (পিঅ্যান্ডজি) তাদের অন্যতম। আবার মাইক্রোসফটের উৎপাদিত পণ্যকে যত মানুষ চেনে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ চেনে এর উদ্যোক্তা বিল গেটসকে। সাধারণ মানুষ ছাড়াও বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছেও বিল গেটস এখন অবশ্যপাঠ্য রেফারেন্স। অথচ পিঅ্যান্ডজির ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত।

সে যা হোক, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও বিকাশমানতার পাশাপাশি এর বিশাল ভোক্তাগোষ্ঠীর আচরণ ও প্রবণতায় প্রণোদিত হয়ে ব্যক্তি-প্রচারবিমুখ পিঅ্যান্ডজি এ দেশে বিনিয়োগ শুরু করেছিল ১৯৯৪ সালে। এরপর সময় যত এগিয়েছে, বাংলাদেশে পিঅ্যান্ডজি পণ্যের (জিলেট, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, প্যান্টিন, ওলে, এরিয়াল, ভিক্স, মি ক্লিন ইত্যাদি ব্র্যান্ডের পণ্যাদি) চাহিদাও ততই বেড়েছে এবং সেই সুবাদে বেড়েছে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণও। আর সে ধারায় মাত্র বছর চারেক আগেই ২০২১ সালে তারা বাংলাদেশের প্রাণ গ্রুপের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হবিগঞ্জে একটি কারখানা স্থাপন করে, যার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার।

তো একনাগাড়ে দীর্ঘ ২৩ বছর বাংলাদেশে ব্যবসা করার পর সে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ২০২১ সালে হবিগঞ্জে নতুন কারখানা স্থাপনের মাত্র চার বছর পেরোতে না পেরোতেই এমন কী ঘটল যে পিঅ্যান্ডজিকে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে? এ ব্যাপারে কম্পানিটির পক্ষ থেকে গত ২৯ জুলাই বলা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশে ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ করতে যাচ্ছি।

এসব পোর্টফোলিও পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা সরবরাহশৃঙ্খলে বিনিয়োগ, উৎপাদনের সঠিক আকার নির্ধারণ ও সঠিক স্থানে স্থানান্তর, দক্ষতা বৃদ্ধি, খরচ হ্রাস এবং আরো নির্ভরযোগ্য ও স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারব।’ (বণিক বার্তা, ৭ অক্টোবর ২০২৫)। তাদের এ বক্তব্যে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের যেসব দুর্বল দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে : এখানে বিনিয়োগের জন্য শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ না থাকা, এটিকে বিনিয়োগের জন্য সঠিক স্থান মনে না করা, নানা অনানুষ্ঠানিক খরচের কারণে এখানে মোট খরচ বেড়ে যাওয়া এবং এখানকার বিনিয়োগ পরিবেশকে অনির্ভরযোগ্য ও অস্থিতিশীল ভাবা।

পিঅ্যান্ডজি কেন বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেপিঅ্যান্ডজির ওই বক্তব্যের বাইরে বণিক বার্তার উল্লিখিত প্রতিবেদনে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর শুল্কনীতির কারণে নিজেদের ব্যয় হ্রাস পরিকল্পনার অংশ হিসেবেও হয়তো তারা বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।

তবে সেই একই প্রতিবেদনে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সাবেক সভাপতি এবং বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী যে ধারণা দিয়েছেন, সেটি আবার খানিকটা ভিন্নতর। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘হয়তো তারা এখান থেকে প্রত্যাশিত রিটার্ন পাচ্ছে না, তাই তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে হয়।’ রূপালী চৌধুরীর এ বক্তব্য পরোক্ষভাবে পিঅ্যান্ডজি কর্তৃপক্ষের বক্তব্যেরই অনুরূপ।

এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ২০২১ সালে কভিড অভিঘাতের পরও পিঅ্যান্ডজির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনকে যেখানে লাভজনক ও শৃঙ্খলাপূর্ণ বিনিয়োগের অনুকূল বলে মনে করা হয়েছে, বাংলাদেশকেই এতত্সংক্রান্ত বিনিয়োগের জন্য সঠিক স্থান বলে ভাবা হয়েছে এবং এখানকার পরিবেশকে তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য ও স্থিতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়েছে, সেখানে বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও স্থানান্তরজনিত বিশাল ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়েও এখন তারা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কেন? এটি বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। ওয়াকিফহাল মহলের ধারণা, প্রত্যাশিত রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, তাদের কাছে তার চেয়েও বড় বিষয় এখন দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

এরূপ অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশি বা বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারীর পক্ষেই ভয়ডরহীনভাবে মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বিনিয়োগ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ভয়ডর থাকলেও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পক্ষে যেহেতু দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু তাদের পক্ষে হয়তো দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। তাই বলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তা করবেন কেন? আর তাঁরা তা করতে রাজি নন বলেই পিঅ্যান্ডজির সিদ্ধান্ত এখন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন পাওয়া বা না পাওয়া এ ক্ষেত্রে একটি অজুহাত মাত্র।

বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলছে। এমনকি বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে হলেও সরকার তা বাড়াতে চায়। কিন্তু কে তাদের বোঝাবে যে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীই এখানে বিনিয়োগ করতে আসবেন না। অবশ্য বিষয়টি তাদের না বোঝার কথা নয়। কিন্তু সেটি বুঝেও তারা যদি তা না বোঝার ভান করে, তাহলে আখেরে পরিণতি হবে এই যে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ তো আসবেই না—বর্তমানে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী আছেন, তাঁরাও পিঅ্যান্ডজির মতো ফাঁক বুঝে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। আর বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এরই মধ্যে যেসব বিদেশি কম্পানি বিডার কাছে নিবন্ধন করে বসে আছে, পিঅ্যান্ডজির সিদ্ধান্ত দেখে তারাও আর সামনের দিকে এগোবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিষয়টি অপ্রিয় শোনালেও এটিই প্রকৃত বাস্তবতা।

তো বর্তমানে দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে আজ তো কেবল পিঅ্যান্ডজি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই দিন পর যে পিঅ্যান্ডজির পথ ধরে অন্যরাও যাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? বরং সে আশঙ্কাই সর্বাধিক। অথচ চমৎকার পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপক হিসেবে এরই মধ্যে বিশেষ নামডাক অর্জনকারী বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান তাঁর উপস্থাপনায় বাংলাদেশকে বৈদেশিক বিনিয়োগের স্বর্গভূমি বানিয়ে ফেলার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, যে ঘোষণায় ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারও রয়েছে (৭-১০ এপ্রিল ২০২৫ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে বিডাপতির উপস্থাপনা)। কিন্তু মানুষ তো এরই মধ্যে বুঝে গেছে, ভালো পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা দিয়ে মানুষকে চমকে দেওয়া গেলেও তাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় না। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিনিয়োগ অনুকূল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং তদনুরূপ ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় নীতিমালা।

অন্যদিকে একই ধরনের চমক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাও। এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে গত ২২ এপ্রিল কাতারে অনুষ্ঠিত আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আমরা পৃথিবীর জন্য আশার এক বাতিঘর হিসেবে দাঁড়াতে চাই।’ এটি আসলে শ্রোতার আবেগকে উসকে দিয়ে ক্ষণিকের জন্য মোহাবিষ্টতা সৃষ্টির ভ্রান্ত চেষ্টা হয়ে গেল না কি? কারণ বাস্তবে মব সৃষ্টির বাইরে বাংলাদেশের এই মুহূর্তের কোনো রাষ্ট্রকর্মই কি অনুকরণীয় হয়ে উঠতে পারার পর্যায়ে আছে? রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পর্যায়ের মানুষরা কেন যে এসব অতিকথনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে হেয় প্রতিপন্ন করেন, তা কেবল তাঁরাই বলতে পারবেন। তাঁরা কি বুঝতে পারেন, এ ধরনের দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলে তাঁরা দেশের ভাবমূর্তিকে কিভাবে হাস্যাস্পদতার পর্যায়ে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন এবং তাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য কিভাবে ক্রমেই আরো অধিক দুরূহ হয়ে পড়ছে! তাঁদের এ ধরনের কথাবার্তা ও আচরণের ফলে পিঅ্যান্ডজির মতো বহুজাতিক কম্পানিগুলোর চলে যাওয়ার আশঙ্কা দিনে দিনে আরো বাড়ছে বৈকি।

সমর্থন অযোগ্য একনায়কত্বও অনেক সময় বিনিয়োগ টানতে পারে, যদি তা স্থিতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত যৌক্তিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে, যেমনটি সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় এই মুহূর্তে আসলেই কি এখানে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার কোনো কারণ আছে? তদুপরি উগ্র পন্থার প্রভাব যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভয় পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই সর্বাধিক নয় কি? আর পিঅ্যান্ডজির মতো আত্মপ্রচারবিমুখ কম্পানি যদি স্থানান্তরের বিশাল ক্ষতি মেনে নিয়েও এভাবে নীরবে চলে যায়, তাহলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ওপর পড়তে বাধ্য। আসলে পিঅ্যান্ডজি হয়তো বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও উগ্র পন্থার প্রসারের মুখে সময় থাকতে আগেভাগে বিদায় হয়ে যাওয়াটাকেই উত্তম বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু এর প্রভাবে অন্যরাও যাতে চলে না যায় এবং একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকা বিনিয়োগসংক্রান্ত বাংলাদেশের অবশিষ্ট ভাবমূর্তিটুকুর যাতে চূড়ান্ত বিনাশ না ঘটে, তজ্জন্য সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশাত্মবোধের ন্যূনতম তাগিদ থেকে হলেও কিছু একটা করতে এগিয়ে আসবে—এটিই প্রত্যাশা।

লেখক : অ্যাজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি; সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়