ক্ষমতা মানুষের পরীক্ষা। কেউ ক্ষমতা পেলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে মানবিক আচরণ করে, আবার কেউ তা ব্যবহার করে মানুষের প্রতি চরম অবিচার, নির্যাতন এবং অহংকারের অন্ধকারে ঢেলে দেয়। ইসলাম ক্ষমতাকে দায়িত্ব হিসেবে দেখেছে— গর্ব বা সুবিধা হিসেবে নয়। যে ক্ষমতা মানুষের উপকারের জন্য দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্ষমতা মানুষ যদি অন্যায়, জুলুম বা স্বার্থপরতার জন্য ব্যবহার করে— তাহলে কুরআন ও হাদিস তার ওপর কঠোর শাস্তির সংবাদ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু দুনিয়ার শাস্তিই বয়ে আনে না— পরকালেও তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ক্ষমতার অপব্যবহারে রয়েছে কুরআনের সতর্কতা—
১. আল্লাহ অত্যাচারী ও অহংকারীদের ধ্বংস করেন
অহংকারকে ইসলামে জাহান্নামের পথ বলা হয়েছে। ক্ষমতার অহংকার—সবচেয়ে বিপজ্জনক অহংকার। আল্লাহ তাআলা বলেন—
إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা নাহল: আয়াত ২৩)
২. জালিম শাসকদের পরিণতি ভয়াবহ
জুলুমের কারণে গোটা জাতিকে ধ্বংস করা আল্লাহর রীতি। ক্ষমতার অপব্যবহারও জুলুমেরই একটি রূপ। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَتِلْكَ الْقُرَىٰ أَهْلَكْنَاهُمْ لَمَّا ظَلَمُوا
‘এ সকল জনপদ—যখন তারা জুলুম করেছে—আমি তাদের ধ্বংস করেছি।’ (সুরা কাহফ: আয়াত ৫৯)
৩. আমানতের খেয়ানতকারী আল্লাহর কাছে ঘৃণিত
অধিকার, দায়িত্ব, ক্ষমতা—সবই আমানত। অমানতের খেয়ানত আল্লাহর কাছে বড় অপরাধ। আল্লাহ তাআলা বলেন—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ...
‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি খেয়ানত কর না…।’ (সুরা আনফাল: আয়াত ২৭)
ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে হাদিসের ভয়াবহ সতর্কতা রয়েছে। হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে তা ওঠে এসেছে—
৪. যিনি জনগণকে কষ্ট দেন—আল্লাহ তাকে কষ্ট দেবেন
ক্ষমতাসীনদের জন্য এই হাদিস সরাসরি ভয়াবহ হুমকি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
اللَّهُمَّ مَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاشْقُقْ عَلَيْهِ…
‘যে আমার উম্মতের ওপর দায়িত্ব পেল এবং তাদের কষ্ট দিল—হে আল্লাহ! তুমি তাকে কষ্ট দাও…।’ (মুসলিম ৪৫৭১)
৫. দায়িত্বে যারা প্রতারণা করে তারা জান্নাত পাবে না
ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতারণার বড় রূপ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلاَحَ فَلَيْسَ مِنَّا وَمَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا
‘যে ব্যাক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়, আর যে ব্যক্তি আমাদের ধোকা দিবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম ১৮৫)
৬. বিচারকের ভুল ও জুলুম—সরাসরি জাহান্নামের কারণ
অন্যায়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে— ফল সরাসরি জাহান্নাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
الْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ: وَاحِـدٌ فِيْ الْـجَنَّةِ، وَاثْنَانِ فِيْ النَّارِ، فَأَمَّا الَّذِيْ فِيْ الْـجَنَّةِ ؛ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْـحَقَّ فَقَضَى بِهِ، وَرَجُلٌ عَرَفَ الْـحَقَّ فَجَارَ فِيْ الْـحُكْمِ ؛ فَهُوَ فِيْ النَّارِ، وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ ؛ فَهُوَ فِيْ النَّارِ
‘বিচারক তিন প্রকারের। একজন জান্নাতি আর অপর দুজন জাহান্নামি। যিনি জান্নাতি তিনি হচ্ছেন এমন বিচারক যে সত্য উদ্ঘাটন করে তার আলোকেই বিচার করেন। আরেকজন এমন যে, তিনি সত্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন ঠিকই তবে তিনি তা সূক্ষ্মভাবে পাশ কাটিয়ে গিয়ে অন্যায় ও অত্যাচারমূলক বিচার করে থাকেন। এমন বিচারক জাহান্নামি। আরেকজন এমন যে, তিনি অজ্ঞতা ও মূর্খতাকেই পুঁজি করে বিচার করে থাকেন। অতএব তিনিও জাহান্নামি।’ (আবু দাউদ ৩৫৭৩, তিরমিজি ১৩২২, ইবনে মাজাহ ২৩৪৪)
ক্ষমতার অপব্যবহার কেন এত ভয়াবহ?
১. এটি অন্যের হক নষ্ট করে
আল্লাহ মানুষের হক নষ্ট হওয়াকে কখনো ক্ষমা করেন না (মানুষ ক্ষমা না করলে)। এ জন্য আল্লাহ তাআলা অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতে নিষেধ করেছেন—
وَ لَا تَاۡكُلُوۡۤا اَمۡوَالَكُمۡ بَیۡنَكُمۡ بِالۡبَاطِلِ
‘আর তোমরা নিজেদের মধ্যে পরস্পরের ধন সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন —
مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لِأَخِيهِ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَيْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ قَبْلَ أَنْ لَا يَكُونَ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْه
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোন বিষয়ে অত্যাচারের জন্য দায়ী সে যেন সেই দিন আসার আগে আজই তার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে যায় (অথবা ক্ষমা চেয়ে নেয়), যেদিন কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। তার যদি কোনো ভাল আমল থেকে থাকে তা থেকে জুলুমের সমপরিমাণ কেটে নেওয়া হবে। আর তার যদি কোন নেকি না থাকে তবে মজলুমের পাপ থেকে কিছু নিয়ে জালেমের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বুখারি ২৪৪৯)
২. এটি সমাজকে ফিতনা, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তিতে ঠেলে দেয়
ক্ষমতায় থেকে জুলুম করা যেমন অপরাধ, তেমনি জুলুমকে সমর্থন করাও সামাজিক ধ্বংস ডেকে আনে। ক্ষমতাসীনদের জুলুম শুধুমাত্র তাদের নয়, পুরো সমাজকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দেয়— এটি আজকের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَ اتَّقُوۡا فِتۡنَۃً لَّا تُصِیۡبَنَّ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡكُمۡ خَآصَّۃً ۚ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ
‘আর তোমরা সেই ফিতনাকে ভয় কর যা তোমাদের মধ্যকার শুধুমাত্র জালিম ও পাপিষ্ঠদেরকেই বিশেষভাবে ক্লিষ্ট করবে না। তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি দানে খুবই কঠোর।’ (সুরা আনফাল: আয়াত ২৫)
وَ لَا تَرۡكَنُوۡۤا اِلَی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ ۙ وَ مَا لَكُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مِنۡ اَوۡلِیَآءَ ثُمَّ لَا تُنۡصَرُوۡنَ
‘আর তোমরা জালিমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না, অন্যথায় তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে, আর আল্লাহ ছাড়া তোমরা কোনো সাহায্যকারী পাবে না, অতঃপর তোমাদেরকে কোনো সাহায্যও করা হবে না।’ (সুরা হুদ: আয়াত ১১৩)
৩. ক্ষমতার অপব্যবহার মানুষের আল্লাহভীতি নষ্ট করে, অহংকার জন্ম দেয়
ফেরাউন ক্ষমতার অহংকারে আল্লাহকে অস্বীকার করেছিল। আর এই ক্ষমতা, অহংকার, জুলুম ও আল্লাহভীতি নষ্ট — এটাই ফেরাউনের পতনের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন—
اِنَّ فِرۡعَوۡنَ عَلَا فِی الۡاَرۡضِ وَ جَعَلَ اَهۡلَهَا شِیَعًا یَّسۡتَضۡعِفُ طَآئِفَۃً مِّنۡهُمۡ
‘নিশ্চয়ই ফেরাউন তার দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণিকে সে হীনবল করেছিল।’ (সুরা আল-কাসাস: আয়াত ৪)
৪. এটি পরকালে সীমাহীন জবাবদিহিতার কারণ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَى الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى اللَّهِ وُجُوهُهُم مُّسْوَدَّةٌ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْمُتَكَبِّرِينَ
‘কিয়ামতের দিন তুমি দেখবে—যারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলেছে (অহংকার করেছে) তাদের মুখ কালো হয়ে যাবে।
অহংকারকারীদের জন্য কি জাহান্নাম যথেষ্ট নয়?’ (সুরা যুমার: আয়াত ৬০)
ক্ষমতাসীনদের জন্য ইসলামের আদর্শ রূপ
ইসলামে ক্ষমতা হলো—
> দায়িত্ব
> জবাবদিহিতা
> ন্যায় প্রতিষ্ঠা
> জনগণের সেবা
> দুর্বলকে রক্ষা করা
> জুলুম প্রতিরোধ করা
ক্ষমতাসীনদের প্রতি এসবই মহান আল্লাহ তাআলার আমানত। আল্লাহ বলেন—
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا
‘আল্লাহ তোমাদের আমানতগুলো যথাযথভাবে আদায় করার নির্দেশ দেন।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৫৮)
ক্ষমতা আল্লাহর দেওয়া এক বিশাল পরীক্ষা। যে ব্যক্তি এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, সে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হয়। আর যে এটি ব্যবহার করে মানুষকে কষ্ট দেয়, অন্যায় চাপায়, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য জুলুম করে—তার পরিণতি হলো ধ্বংস, লাঞ্ছনা এবং কেয়ামতের কঠিন শাস্তি।
মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা কখনো স্থায়ী নয়— কিন্তু ক্ষমতার ব্যবহারের হিসাব আল্লাহর আদালতে চিরস্থায়ী। তাই আসুন— নিজ নিজ অবস্থানে আমরা আমানতদার, ন্যায়পরায়ণ এবং আল্লাহভীরু হওয়ার চেষ্টা করি। কারণ আল্লাহ বলেন— ‘জালিমদের জন্য কোনো নাজাত নেই।’
সূত্র: যুগান্তর