ইরানের ধীরগতিতে পারমাণবিক পুনর্বাসনের কাজ চলছে। দেশটি তার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক প্রসারিত করে চলেছে। ইসরায়েলও সতর্কতা দিয়ে যাচ্ছে। এসব থেকে বোঝা যায়, দুই দেশের মধ্যে পরবর্তী ধাপের যুদ্ধ দ্রুত এগিয়ে আসতে পারে। মার্কিন গণমাধ্যম দ্য মিডিয়া লাইনের এক বিশ্লেষণে এই দাবি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আক্রমণ করার প্রায় ছয় মাস পরে, ক্রমবর্ধমান ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, আগামী মাসগুলিতে ফের একটি সংঘাতে লিপ্ত হতে পারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে ইরানে।
গত সোমবার একটি সম্মেলনে বক্তৃতাকালে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আমির বারাম বলেন, ‘‘সব ফ্রন্ট এখনও খোলা রয়েছে।’’ ইরান এবং গত জুনে আমেরিকান-ইসরায়েলি যৌথ হামলার পর দেশটির পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে তিনি এই কথা বলেন।
ইসরায়েলি ওয়েবসাইট ওয়াইনেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কর্মকর্তা বলেন, ইরান তাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে তিনি বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল আগামী এক বছরের মধ্যে ইরানে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেবে।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একাধিক পোস্টে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি দাবি করেন, ইরান যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। খামেনি লিখেছেন, ‘‘১২ দিনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠী এসে বিদ্বেষপূর্ণ কাজ করেছে। তারা মার খেয়েছে এবং খালি হাতে ফিরে গেছে। অর্থাৎ, তারা তাদের কোনো উদ্দেশ্যই অর্জন করতে পারেনি।’’
যুদ্ধের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, পারমাণবিক হুমকি আবার শুরু হলে ইসরায়েল আবার আক্রমণ করবে।দ্য মিডিয়া লাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে ইসরায়েলের জন্য হুমকি কেবল পারমাণবিক ছিল না।
ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মতে, ইরান ইসরায়েলের দিকে ৫৫০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। সেগুলোর মধ্যে ৬৩টি ইসরায়েলের বহুস্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সক্ষম হয়, যার ফলে ২৯ জন ইসরায়েলি নিহত এবং ৩,০০০ জনেরও বেশি আহত হন। উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলিতে আঘাত হানা হয় এবং তা ধসে পড়ে। এতে ১৫,০০০ এরও বেশি ইসরায়েলিকে অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে হয়। দেশের অনেকের কাছেই এটি ছিল একটি সতর্কতা যে, একটি শত্রুভাবাপন্ন সরকারের হাতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকা একটি বড় হুমকি।
ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের ইরান বিশেষজ্ঞ বেনি সাবতি দ্য মিডিয়া লাইনকে বলেন, ‘‘কোনো সন্দেহ নেই যে আমরা দ্বিতীয় দফা সংঘাত দেখতে পাব।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এটি সময়ের এবং বৈধতার বিষয়।’’
তেহরানের পারমাণবিক আকাঙ্ক্ষাগুলির আসন্ন বাস্তবায়নকে ব্যর্থ করার অজুহাতে ইসরায়েল জুনে ইরানে তার প্রতিরোধমূলক হামলা শুরু করে। ১২ দিনের এই আক্রমণের শেষের দিকে মার্কিন বাহিনীও যোগ দেয়। এই আঘাতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পঙ্গু হয়েছে বলে মনে করা হয়।
জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির ইরান বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মেজর (অব.) অ্যালেক্স গ্রিনবার্গ দ্য মিডিয়া লাইনকে বলেন, ‘‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এমন পর্যায়ে ধ্বংস করা হয়েছে যে এটির কার্যকারিতা শূন্য।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কর্মসূচিটি পুনরায় শুরু করার জন্য প্রচুর সম্পদের প্রয়োজন যা এই মুহূর্তে ইরানের কাছে নেই।’’
ইরান বর্তমানে এক গভীর আর্থ-সামাজিক এবং জ্বালানি সংকটের মধ্যে রয়েছে। দেশটির অর্থনীতিতে কার্যত কোনো প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি। বিশাল তেল ও গ্যাস মজুদ থাকা সত্ত্বেও, কয়েক দশকের অবকাঠামো অবহেলা, অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, অব্যবস্থাপনা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ‘সন্ত্রাসী সংগঠনগুলিতে’ তহবিল পাঠানোর কারণে জ্বালানি উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিপর্যয় এবং পানি ঘাটতি কেবল শিল্পকেই নয়, সাধারণ জনগণকেও প্রভাবিত করেছে।
ইরান হয়তো তার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলিকে আপাতত পিছিয়ে দিতে পারে, তবে দেশটি এখনও হাজার হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী বলে মনে করা হয়।সাবতি বলেন, ‘‘প্রশ্ন হলো ইসরায়েলের আক্রমণের কারণ হিসেবে পারমাণবিক কার্ডের প্রয়োজন আছে কি না।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘সিদ্ধান্তটি ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার উপর নির্ভর করে। পারমাণবিক কার্ড না থাকলে, ইসরায়েল ক্ষেপণাস্ত্র হুমকির ভিত্তিতে আক্রমণের বৈধতা চাইবে।’’
সাবতি এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন হলো, আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ইসরায়েলি আক্রমণ ঘটতে পারে।এই বছরের অক্টোবরে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) বিশ্লেষণ করা স্যাটেলাইট চিত্রগুলিতে ইরানের পিক্যাক্স মাউন্টেন নামক স্থাপনায় নির্মাণ কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। এর পরিধির চারপাশে একটি নিরাপত্তা প্রাচীর তৈরি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনা সম্পর্কেও সিএসআইএস একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
সাবতি বলেন, ‘‘ইরানিরা খুব, খুব ধীরে ধীরে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছে। হামলার ফলে সাইটগুলি সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে গেছে, কিন্তু তারা সেই সাইটগুলিতে যাওয়ার রাস্তা এবং সুড়ঙ্গগুলি ঠিক করার চেষ্টা করছে, প্রধানত লজিস্টিক্যাল দিকগুলি নিয়ে কাজ করছে।’’ এই সব কিছুই ইসরায়েলি এবং আমেরিকান দের খুব সতর্ক নজরে ঘটছে বলে জানান তিনি।গ্রিনবার্গ বলেন, ‘‘ইরান স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য দেখানোর চেষ্টা করছে এবং সম্ভবত তার ব্যালিস্টিক সক্ষমতা উন্নত করার চেষ্টা করবে।’’
সাবতি বলেন, ‘‘এখনও আঘাত করার মতো অনেক লক্ষ্য রয়েছে। ইরানের মতো একটি বিশাল দেশকে মোকাবিলা করার জন্য বারো দিন যথেষ্ট নয়; যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হতে পারত। ইরান ইতিমধ্যেই সবকিছু পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছে, যার মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া পারমাণবিক সাইটগুলি মেরামত করার জন্য ছোট পদক্ষেপ নেওয়াও অন্তর্ভুক্ত।’’
সূত্র: ইনকিলাব