ডয়েচেভেলে : বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের প্রভাব নতুন কিছু নয়। আর্থিক সামর্থ্য, রাজনৈতিক সংযোগ এবং শক্তিশালী ও নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের দৌলতে ভারত বহু বছর ধরেই বিশ্ব ক্রিকেটের চালচিত্র নির্ধারণ করে এসেছে।
তবে জয় শাহর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর এই প্রভাব নতুন মাত্রা পেয়েছে— যা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ।
বিলিয়ন ডলারের দখল--
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড ভারতের বিসিসিআই (বিসিসিআই)। ২০২৪ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বিসিসিআই একাই আইসিসি’র মোট রাজস্বের ৩৯ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১.১৫ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর পেছনে মূল চালিকা শক্তি ভারতীয় উপমহাদেশের ১৪০ কোটিরও বেশি দর্শকভিত্তিক সম্প্রচার বাজার।
এই অর্থনৈতিক সক্ষমতাই ভারতকে আইসিসি ইভেন্টের সময়সূচি, সম্প্রচার স্বত্ব, এমনকি নীতিনির্ধারণেও মুখ্য ভূমিকা নিতে সাহায্য করছে।
আইপিএল: রাজনীতির ছায়া ও শক্তি----
বিসিসিআই-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) শুধুমাত্র একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়, বরং ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবিও বটে।
বর্তমান আইপিএল চেয়ারম্যান অরুণ ধুমাল হলেন ভারতের শাসক দল বিজেপির সংসদ সদস্য অনুরাগ ঠাকুরের ভাই। ঠাকুর নিজেও এক সময় বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট ছিলেন—যদিও ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় অনিয়মের অভিযোগে।
২০০৮ সালের উদ্বোধনী আসরে পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা খেললেও মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর তাদের আর আইপিএলে দেখা যায়নি। ভারত সরকার তাদের ভিসা বাতিল করে এবং বিসিসিআই নীরবে ভবিষ্যতের নিলাম থেকে তাদের বাদ দেয়।
এমনকি আইপিএলের সময়সূচিও নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। যেমন ২০০৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখিয়ে পুরো আসরই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২০১৪ সালের কিছু ম্যাচও চলে গিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
জয় শাহ: ক্রিকেট ও রাজনীতির সংমিশ্রণ-----
জয় শাহ শুধু বিসিসিআই-এর সচিবই নন, তিনি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্রও। আইসিসি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে তার দ্বৈত ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঐতিহ্যগতভাবে আইসিসি প্রধানকে নিরপেক্ষ থাকা উচিত, কিন্তু জয় শাহ সেই রীতিকে ভেঙেছেন। যদিও পরে সচিবের পদ ছেড়ে দেন তিনি।
তার পূর্বসূরি গ্রেগ বার্কলে, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব ছেড়ে আইসিসি প্রধান হয়েছিলেন। পদত্যাগের সময় এক সাক্ষাৎকারে বার্কলে বলেন, “আমরা ভারতের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ, কিন্তু এক দেশের এত ক্ষমতা বৈশ্বিক ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটায়, যা ক্রিকেটের বিশ্বায়নের জন্য ভালো নয়।
জয় শাহ এখনো তার সম্ভাব্য বিতর্কিত অবস্থান নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় বলেছিলেন, “আমি আইসিসি এবং সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করে ক্রিকেটকে আরও বিশ্বায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ক্রিকেটার ও রাজনীতিক গৌতম গম্ভীর---
ভারতের সাবেক ওপেনার গৌতম গম্ভীর ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দেন এবং সম্প্রতি রাজনীতি ছেড়ে ভারতের জাতীয় দলের প্রধান কোচ হয়েছেন। কাশ্মীরে ২০২৫ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট বন্ধ করার দাবি জানান। যদিও বিসিসিআই বা বিজেপি সেই বক্তব্য সমর্থন করেনি, তবুও এটা ভারতীয় ক্রিকেটের রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা তুলে ধরে।
ভারত-পাকিস্তান: রাজনৈতিক টানাপড়েনে ক্রিকেট ---
ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সিরিজ ২০১৩ সালের পর আর হয়নি। ২০২৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ভারতে খেললেও ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালে ভারত সরকার পাকিস্তানে খেলতে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। দীর্ঘ আলোচনার পর ঠিক হয়, আগামী পাঁচ বছর ভারত-পাকিস্তান ম্যাচগুলো নিরপেক্ষ ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে। তবে জয় শাহের অধীনে পাকিস্তানকে চূড়ান্ত অপমান সহ্য করতে হয়, যখন ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল পাকিস্তানের লাহোর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ভারতের ফাইনালে ওঠার পর।
আধিপত্য বনাম ভারসাম্য ---
ভারতের আর্থিক ক্ষমতা বিশ্ব ক্রিকেটে আধুনিকতা ও বাণিজ্যিক সাফল্য এনেছে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি একটি মনোপলি গঠনের দিকে এগোচ্ছে। এর ফলে পাকিস্তান ও ছোট দেশগুলো পিছিয়ে পড়ছে, আর বিশ্ব ক্রিকেটের বৈচিত্র্য ও ন্যায্যতা পড়ছে প্রশ্নের মুখে।