মহসিন কবির: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। জনরোষের মুখে সেদিন পালিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ভারত একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দেয়। ভারতের মিডিয়াগুলা মিথ্যা খবর প্রকাশ করে যাচ্ছেন। আগস্টের পর থেকে ঢাকা-দিল্লির মধ্যে বিরোধ বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে পুশইন। আবার দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলোতে আলোচনাও হচ্ছে না।
এছাড়া ‘শনিবার (১৭ মে) ভারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অজয় ভদ্র স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস, তুলা, সুতির বর্জ্য, কার্ড ও প্লাস্টিক ও কার্ডের তৈরি আসবাবপত্র, ফল জাতীয় পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার পর বেনাপোল বন্দরে শতাধিক রফতানিমুখী গার্মেন্টস পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। ভারত সরকারকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বাণিজ্য সহজ করার দাবি জানাচ্ছি।’
এদিকে বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে কলকাতার বিকল্প সংযোগ গড়ে তুলতে সমুদ্রপথে একটি নতুন করিডর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার।
গতকালও ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে ১৭ জনকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এদিন ভোর ৫টার দিকে জেলার হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়া ইউনিয়নের রামপুর সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এছাড়া মৌলভীবাজারের তিন সীমান্ত দিয়েও পুশইনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই পুশইনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক সহসাই স্বাভাবিক হচ্ছে না। সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তারা। তারা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও কিছু ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক টানাপড়েন উসকে দেয়। পুশইন বা জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ ঘটানো একটি স্পর্শকাতর ইস্যু, যা শুধু মানবিক নয়, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকদের পুশইনের অভিযোগ সামনে আসছে, যা নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। প্রথমেই দিল্লি সব ধরনের ভিসা বন্ধ করে বাংলাদেশিদের জন্য। পরে অবশ্য চিকিৎসা ভিসা চালু করে সীমিত আকারে। আর এরমধ্যে সীমান্ত হত্যাসহ নানা ইস্যুতে সীমান্ত উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে কয়েক দফা কূটনৈতিক বার্তা দেওয়া হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ভারত। এবার আবার গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগাম ঘটনার পর থেকে নতুন করে ধরপাকড় শুরু করে এবং বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পুশইন শুরু করে। এরমধ্যে ৫ মে থেকে ৭ মে পর্যন্ত তিনদিনে ৩০০’র বেশি নাগরিককে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। যার মধ্যে রোহিঙ্গা ও ভারতের নাগরিক ছিল।
এদিকে গতকাল শনিবারও পুশইন নিয়ে কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। তিনি সাতক্ষীরায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশইন সমস্যা প্রতিরোধে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ সবসময় আন্তর্জাতিক আইন ও প্রটোকল অনুসরণ করে আসছে। আমরা ইতিমধ্যে এ সমস্যা সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতকে চিঠি লিখেছি। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান এ সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভারত যেহেতু ৩৭০ জনকে পুশইন করেছে, বাংলাদেশেরও একইভাবে পুশব্যাক করার ইচ্ছা আছে কি না, এ সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তারা যদি আমার দেশের নাগরিক হয়, তাহলে তো পুশব্যাক করার অধিকার আমাদের নেই। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যারা অবৈধ ভারতীয় আছে, তাদের আমরা এভাবে পুশব্যাক করব না। আমরা তাদের যথাযথ চ্যানেলে ফেরত পাঠাব। কেননা, পুশইন বা পুশব্যাক কোনো আইনসম্মত পদ্ধতি নয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, পুশইন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তি, এমনকি শিশু ও বৃদ্ধদেরও জোরপূর্বক সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে। জোরপূর্বক ব্যক্তিদের প্রবেশ করানো বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের জন্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এটি দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ ও উত্তেজনা বাড়াতে পারে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও পুশইনের মতো কাজ বিশ্বাস ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিনষ্ট করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এর জন্য আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। ভারত সরকার বিষয়টি জানে। বাংলাদেশ থেকে কূটনৈতিক বার্তার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হলে প্রতিবেশীর প্রতি ন্যায়সংগত আচরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, পুশইন আইন পরিপন্থী। আর এটা জেনেও ভারত তা করছে। বিষয়টি উদ্বেগের। এক দেশ থেকে আরেক দেশে লোক পাঠাতে হলে দুই দেশের মধ্যে সম্মতি থাকতে হয়। এক দেশের কোনো নাগরিক আরেক দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে তাকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন অনুসরণ করে ফেরত পাঠাতে হয়।
পুশইন প্রক্রিয়া ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা লঙ্ঘন করে। প্রত্যেক অভিবাসী বা সীমান্ত পার হওয়া ব্যক্তির যথাযথ শুনানির অধিকার রয়েছে।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ভারত থেকে পুশইনের মাধ্যমে ২৯২ জন ব্যক্তিকে বিজিবি আটক করেছে। তাদের মধ্যে ২৫৩ জন বাংলাদেশি, ১৯ জন রোহিঙ্গা এবং বাকি ২০ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। আর সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে কোস্টগার্ড আটক করেছে ৭৮ জনকে। সাতক্ষীরায় ৭৮ জনের মধ্যে তিনজন জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক। মোট আটকের সংখ্যা ৩৭০ জন।
গত ৪ থেকে ৭ মে বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা দিয়ে ভারত থেকে ১৬৭ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জনকে খাগড়াছড়ি, ৪৬ জনকে কুড়িগ্রাম, ২৩ জনকে সিলেট, ১৫ জনকে মৌলভীবাজার, ১০ জনকে চুয়াডাঙ্গায় পুশইন করা হয়েছে। ৯ মে শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জনকে ফেলে রেখে যায় বিএসএফ। তারা কয়েক দিন না খেয়ে থাকার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে একজনের হাত ভেঙে গেছে আর কয়েকজনের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে।
বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে ভারতের সমুদ্রপথে একটি নতুন করিডর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো (সেভেন সিস্টার্স) স্থলবেষ্টিত অঞ্চল। এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক হলো বাংলাদেশ। এছাড়া চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে যেন বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয় সে জন্য মেঘালয়ের শিলং থেকে আসামের শিলচর পর্যন্ত চার লেনের নতুন মহাসড়ক তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ভারত। যা ২০৩০ সালে সম্পন্ন হবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ভারতের জাতীয় মহাসড়ক এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করপোরেশন লিমিটেডের (এনএইচআইডিসিএল) এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এই সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, বর্তমানে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো যুক্ত হওয়ার একমাত্র পথ হলো শিলিগুড়ি করিডর। যা ‘চিকেন নেক’ নামেও পরিচিত। এছাড়া মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মাধ্যমেও ভারত তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে যুক্ত করতে পারে। তবে বাংলাদেশ যেহেতু বঙ্গোপসাগরে ভারতের চলাচল সীমিত করেছে তাই কালাদান প্রজেক্টকে ভারত ও মিয়ানমার বিকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যখন শিলং-শিলচরের মধ্যে মহাসড়কটি নির্মাণ শেষ হবে তখন মিয়ানমার হয়ে কলকাতা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যকে যুক্ত করার কাজও শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নতুন করিডরটি শিলংয়ের কাছে মাওলিঙ্গখুং থেকে শুরু হয়ে আসামের শিলচরের কাছে পাঁচগ্রামে গিয়ে শেষ হবে। এটি ১৬৬.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং জাতীয় মহাসড়ক ৬-এর অংশ হিসেবে নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পের ১৪৪.৮ কিমি অংশ পড়ছে মেঘালয়ে এবং ২২ কিমি অংশ আসামে। নির্মাণকাজ ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে জানানো হয়েছে।
পুশইন নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ভারত থেকে পুশইনের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে বাংলাদেশি থাকলে তাদের পুশব্যাক করার সুযোগ নেই। তবে ভারতের নাগরিক ও দেশটির রোহিঙ্গারা থাকলে তাদের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় ফেরত পাঠানো হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভারতে কোনো অবৈধ বাংলাদেশি থেকে থাকলে তাদের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় ফেরত পাঠাতে হবে। ভারতের পুশইনের ঘটনায় প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তবে এ ঘটনাকে উসকানিমূলক মনে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, পুশইনের মাধ্যমে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে রোহিঙ্গাও রয়েছে। এছাড়া, ইউএনএইচসিআরের কার্ডধারী ব্যক্তিরাও রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ সময় পুশইনের বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য মতে, কাশ্মীরের পেহেলগাম কাণ্ড ঘিরে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ছায়া পড়েছে বাংলাদেশ সীমান্তেও। এর প্রভাব পড়েছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ এই তিন ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলায়। সম্প্রতি এসব এলাকায় একের পর এক পুশইন ও অনুপ্রবেশের ঘটনায় সীমান্ত জুড়ে তৈরি হয়েছে চরম উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) অন্তত দুই শতাধিক নারী, শিশু, রোহিঙ্গা, ভারতীয় ও বাংলাদেশিকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পুশইন করেছে। এর মধ্যে ১৩৩ জনকে বিভিন্ন সীমান্ত থেকে আটক করেছে বিজিবি।