শিরোনাম
◈ চিঠি লিখে ভারতকে একহাত নিলেন নেপালের পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী ◈ লাইফ সাপোর্টে ফরিদা পারভীন ◈ এ‌শিয়া কাপ, ৪ ওভার ৩ বল খে‌লে আরব আ‌মিরাত‌কে হারা‌লো ভারত ◈ আগুন জ্বলে উঠতে পারে ভারতেও, শিবসেনা নেতার সতর্কতা ◈ অবশেষে খোঁজ মিললো ক্ষমতাচ্যুত নেপালি প্রধানমন্ত্রীর ◈ ডাকসু নির্বাচন: শিবিরকে অভিনন্দন জানিয়ে দেয়া পোস্ট সরিয়ে ফেললো পাকিস্তান জামায়াত! ◈ ৫ ট্রলারসহ সাগর থেকে ৩০ জেলেকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি ◈ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নতুন প্রশিক্ষণ নীতি: মেয়াদ ৪ মাস, মাঠপর্যায় অন্তর্ভুক্ত ◈ ৫ শিক্ষার্থীকে নিয়ে আদমদীঘিতে পুকুরে ধসে পড়ল শ্রেণিকক্ষের মেঝে ◈ জামায়াত আমিরের বাড়িতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার, নির্বাচন নিয়ে হলো আলোচনা

প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১২:২২ দুপুর
আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১২:০০ রাত

প্রতিবেদক : মহসিন কবির

সাবেক সচিবরা দলীয়করণের খেসারত দিচ্ছেন!

মহসিন কবির: সাবেক সচিবরা জনতার মঞ্চ তৈরি করে আমলাতন্ত্রকে নষ্ট করেছেন, এমনটাই মনে করছেন প্রশাসনের তরুণ কর্মকর্তারা। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ তৈরি করেন প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দেশের ক্ষতি করেছেন প্রশাসনকে দলীয়করণের মাধ্যমে। এর খেসারত হিসবে এখন জেলে যেতে হচ্ছে। 

ফলে প্রশাসনের তরুণ কর্মকর্তারা ভাবছেন, যারা প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতার সবক দিতেন, তাদের একটা অংশ নিজেরাই প্রশাসনকে কলুষিত করেছেন রাজনীতির মাধ্যমে। এর জেরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জেলে গেছেন। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান। ঢাকা মহানগর পুলিশ রবিবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে গতকাল গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।

এর আগে স্বরাষ্ট্র ও নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবা উদ্দিন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও সংসদ সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, সাবেক সচিব ও নির্বাচন কমিশন সচিব হেলাল উদ্দিন আহম্মদ, সাবেক সমাজকল্যাণ সচিব ইসমাঈল হোসেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল প্রমুখ কারাগারে রয়েছেন।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার উপ প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে শহীদ খানকে ওএসডি হয়ে থাকতে হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ

আবার ক্ষমতায় এলে তিন মাসের মধ্যে পরপর চারটি পদোন্নতি দিয়ে তাকে জ্যেষ্ঠ সচিব করা হয়। সে সময় তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী সচিব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে তিনি ২০১৫ সালে অবসরে যান। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করতেও আগ্রহী ছিলেন সাবেক এই আমলা। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে সচিবালয়ে আওয়ামীপন্থি কিছু আমলাকে নিয়ে গঠিত হয় ‘জনতার মঞ্চ’।

ওই মঞ্চ গঠনের প্রধান কুশীলব ছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মহীউদ্দীন খান (ম খা) আলমগীর। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তার হাত ধরে প্রশাসনে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মহোৎসব শুরু হয়। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম (প্রয়াত) প্রশাসনে দুর্নীতি ও রাজনীতিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ রূপ দিয়ে যান। ১৯৯৬ সালে সচিবালয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরোধী ‘জনতার মঞ্চ’র অন্যতম সংগঠক ছিলেন আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রংপুরে নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।

শেখ হাসিনার আমলে দলীয় কর্মীর মতো প্রশাসনকে ব্যবহার করতেন কিছু আমলা। তাদের ওপর নির্ভর করত পদোন্নতি ও ভালো পদায়ন। এ কারণে একটা পর্যায়ে দেশের সাধারণ জনগণের ভোটের পরিবর্তে প্রশাসন ও পুলিশের ওপর ভরসা করতে শুরু করে তৎকালীন সরকার। পর পর তিনটি নির্বাচনের ফলাফলও পক্ষে আনতে ভূমিকা রাখেন তারা। অথচ রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দলমত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে বৈষম্যহীনভাবে সেবা প্রদান করা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর সাংবিধানিক দায়িত্ব।

আবু আলম শহীদ খানসহ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার ও জেলে যাওয়ার ঘটনায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে গতকাল বেশ আলোচনা ছিল। তারা বলাবলি করতে থাকেন- এই ব্যক্তিদের কারণে সামাজিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। এখনও দলবাজি করলে একই পরিণতি হবে। সুতরাং কোনো দল নয়, দেশের স্বার্থে কাজ করতে প্রশাসনের সব কর্মকর্তার ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি বলে মনে করেন একাধিক কর্মকর্তা।

অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পদোন্নতি বা পদায়নের কারণে অনেক সময় রাজনীতিবিদদের কাছে ধর্না দিতে হয়। এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি। তাহলে জনপ্রশাসন আরও নিরপেক্ষ হবে। শুধু তাই নয়, চাকরি সুরক্ষায় সংস্কার আনা জরুরি। নইলে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের হবে না প্রশাসন।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, জনপ্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নেতাদের পেছনে ঘোরেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বাড়তি সুবিধার আশায় অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। জনপ্রশাসন সংস্কারে এটাই হওয়া উচিত মুখ্য বিষয়।

সূত্রমতে, অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় কেবল সচিবরা মামলা ও জেল-জরিমানার মুখোমুখি হচ্ছেন এমন নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংসদ সচিবালয়ের একজন যুগ্ম সচিব সীমান্তে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন বিজিবির হাতে। তার নাম কিবরিয়া মজুমদার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস পালিয়ে যান। এরপর তাকে বরখাস্ত করলে ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘অবৈধ ইউনূস সরকার আমাকে নাকি বরখাস্ত করছে! আজ থেকে আমি মুক্ত, স্বাধীন। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে, এমন অথর্ব সরকারের অধীনে আমাকে একদিনও চাকরি করতে হয়নি। থ্রি চিয়ার্স ফর “মোখলেসীয় সিভিল সার্ভিস”।’

শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তিনটি নির্বাচনে অন্যায় কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বড় দৃষ্টান্ত। ওই কর্মকর্তাদের অনেকেই বাধ্যতামূলক অবসরে যান। আবার কাউকে ওএসডি করা হয়।

দেখা গেছে, ডিসি নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। সবাইকে নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংস্থার গোপন প্রতিবেদন ও দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তিনটি নির্বাচনের মধ্যে বেশি আলোচনায় রাতের ভোট হিসেবে খ্যাত ২০১৮ সালের নির্বাচন। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হতে ভূমিকা রাখেন অনেক কর্মকর্তা। তাই জনগণের ভোটের চেয়ে কর্মকর্তাদের তুষ্ট রাখা গুরুত্ব পেয়েছে তৎকালীন সরকারপ্রধানের কাছে। এজন্য কর্মকর্তারা যখন-তখন স্বপ্রণোদিত হয়ে টুঙ্গিপাড়া সফরকে রাষ্ট্রীয় কাজ হিসেবে তুলে ধরতেন। পদোন্নতি ও বদলি বিশেষ করে ডিসি-এসপির ফিটলিস্টে দলীয় পরিচয় যুক্ত করতেন বাড়তি যোগ্যতা দেখাতে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল। সেগুলোর রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, এসপি, ওসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা খতিয়ে দেখার দাবি জোরালো হচ্ছে। কারণ ওই সময় অন্তত ৫৮৬টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নৌকা শতভাগ ভোট পায়। ধানের শীষ ১ হাজার ২৮৫টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পায়নি। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালকে জানান, আগের রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরার নির্দেশনা ছিল ২০১৮ সালে।

অতীতে দেখা গেছে, প্রতিবারই ফেনী-১ আসনে জয়ী হয় বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এই আসনে একাদশ নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৪ হাজার ৯৭২টি ভোট পায়। নৌকা প্রতীকে জাসদের শিরিন আখতার দুই লাখ চার হাজার ২৫৬টি ভোট পেয়েছেন বলে দেখানো হয়। এমন অস্বাভাবিক ফলাফল ছিল নোয়াখালী, লক্ষ¥ীপুরসহ সারাদেশেই।

সে সময় রাতের বেলায় বাক্স ভরার অভিযোগে নির্বাচনের দিন সকাল বেলায় শতাধিক আসনে ভোট বর্জন করেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। অস্বাভাবিক ফলাফলের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে দেখানো হয়। বিএনপি পায় ৬টি আসন। আওয়ামী লীগ ২৫৮ এবং জাতীয় পার্টি ২২টি আসন পায়। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোট কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ফেনী জেলায় তিনটি আসনেই জয়ী দেখানো হয় আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীদের। অভিযোগ আছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচনে কারচুপি করা হয়। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসব কা-ে বাধা দেননি, বরং তাদের অনেকের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল ভোট কারচুপিতে। এর জেরে কারাগারে দিন কাটানো থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতে আরও করুণ পরিণতি হবে বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়