মহসিন কবির: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবও অনুমোদন দিয়েছে। যাতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
কার্যক্রম অবৈধ, বেআইনি নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ফেসবুক পোষ্টে প্রতিবাদ জানান। আইন কি বলে এটা নিয়ে আইনজীবীরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। চোরাগোপ্তা হামলাও করতে পারে। বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করবে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে। যে আইনের প্রয়োগ করে ইতোপূর্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ওই আইনের তফসিল-২ এ ওই সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, ধারা ১৮ অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হলে একই আইনের চতুর্থ অধ্যায় ও ১৭ ধারা অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ও সন্ত্রাসী কার্যে জড়িত হিসাবে গণ্য করতে হবে।’’
‘এই আইনের ৮ ও ৯ ধারা মোতাবেক নিষিদ্ধ সত্ত্বার সদস্যপদ গ্রহণ ও সমর্থন করাটাও ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে ৬ মাস থেকে ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডও হতে পারে। নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, তার বিস্তারিত বিবরণ ধারা ২০ এ উল্লিখিত রয়েছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে, তাৎক্ষণিকভাবে উপরোল্লিখিত জেল-জরিমানার বিধান কার্যকর হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ অনেক ব্যাপক। ৯ নম্বর ধারাটি পড়ে দেখা যেতে পারে। আপনার উদ্দেশ্য যদি হয়, কোনও নিষিদ্ধ সত্তার কর্মকাণ্ডকে সক্রিয় করা এবং সেলক্ষ্েয ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোনও তথ্য প্রচার করেন, তাহলে সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে-ধারা ৯(২)। সেক্ষেত্রে ২-৭ বছর কারাদণ্ড ও এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও হতে পারে। আসলে নির্ভর করবে আইনের প্রয়োগের ওপর। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ফেসবুকে ছবি/লেখা প্রকাশ/ শেয়ার করার কথিত অপরাধে বিগত সরকারের আমলে অনেকে এই ধারার অধীনে কারাভোগ করেছেন— এমন অনেক মামলা আমি আইনজীবী হিসেবে পরিচালনা করেছি।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, পলিটিক্যাল পার্টি অধ্যাদেশ- ১৯৭৮ এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইন- ২০০৯, এই দুটি আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বরখাস্ত, সাময়িক অথবা আজীবন নিষিদ্ধের সুযোগ রয়েছে। তবে এখানে অনেকগুলো বিষয়ে বিতর্ক বা বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, পলিটিক্যাল পার্টি অধ্যাদেশ- ১৯৭৮ এর বিধান অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল বা তাদের কর্মকাণ্ড যদি বাতিল করতে হয়, তাহলে হাইকোর্টের কাছে রেফারেন্স আকারে পাঠাতে হয়- যা হাইকোর্ট মামলার মতো করে দুই পক্ষের শুনানী করেন।
বিধিমালা অনুযায়ী, দেশের স্বাধিনতা-সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ব্যত্যয়, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার মতো কতগুলো নির্দিষ্ট বিষয়ে যদি সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকে তাহলেই হাইকোর্টে রেফারেন্স আকারে পাঠানো যায়। এরপর শুনানী করে যে সিদ্ধান্ত দেন, সেটিই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করে পরবর্তীতে সরকার তা প্রচার করে।
এছাড়া সন্ত্রাস দমন আইনেও এটি করার সুযোগ রয়েছে বলে জানান মি. বড়ুয়া। এই আইন অনুযায়ী, যদি কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত আছে, আর্থিক লেনদেন রয়েছে অথবা রাজনৈতিক দলটিকে সন্ত্রাসের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ থাকে তাহলেও দলটিকে সাময়িক সময়ের জন্য বা চিরতরে নিষিদ্ধ করার সুযোগ আছে।
অবশ্য এক্ষেত্রে মানবতা বিরোধী অপরাধ কিংবা গণহত্যা চালিয়েছে কিনা- সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আইনের সব মানদণ্ডগুলো ঠিক থাকলে তবেই একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা যায় বা তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার আহসানুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ যেভাবে ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেভাবেই আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলছেন, এই আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বা যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর বলে সরকার মনে করে তাহলে ওই ব্যক্তি বা সত্ত্বাকে নিষিদ্ধ করতে পারে।
কিন্তু নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার এই বিষয়টি বিতর্কযোগ্য বলেও মনে করেন তিনি। কারণ ব্যক্তি বা সত্ত্বার মধ্যে আইনগতভাবে রাজনৈতিক দল পড়ে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এছাড়া পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮ সম্পর্কে মি. করিম বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর অথবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে সরকার মনে করে, তাহলে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সাময়িক অথবা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা যেতে পারে। তবে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা রয়েছে বলেও জানান মি. করিম।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি (পিবিএসপি) ও পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (পিবিসিপি) নিষিদ্ধ করা হয়। দুটি বামপন্থি মাওবাদী সংগঠন এখনও নিষিদ্ধ।
এছাড়া ২০০৫ সালে দেশজুড়ে বোমা হামলার পর জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশকে (জেএমবি) সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৯ সালে হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ হয়। সবশেষ গত বছরের ২৩ অক্টোবর ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করা হয়।