আলম খোরশেদ: পদ্মা সেতু পারাপারের পরিকল্পনার সময়ই ঠিক করে রেখেছিলাম, এ যাত্রায় যেভাবেই হোক টুঙ্গিপাড়ায় নির্মিত বাঙালির পরম তীর্থ বঙ্গবন্ধুর সমাধিক্ষেত্রটি দেখে আসব। কেননা সমাধিটি নির্মিত হবার দুই দশক পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি সেখানে যেতে না পারার জন্য একটা গভীর হতাশা ও বিষাদ কুরে কুরে খেত আমাকে সবসময়। আর তাই সেদিন পদ্মা সেতু পাড়ি দেবার পর, আমাদের আপ্যায়ক ভাঙা উপজেলার মেয়রের বাড়িতে বিলম্বিত রাজসিক প্রাতরাশ সেরেই আমরা সদলবল রওনা দিই সেই বহুল প্রতীক্ষিত তীর্থদর্শনের উদ্দেশে। চমৎকার বৃক্ষশোভিত সবুজে ছাওয়া সুমসৃণ সড়কের দুপাশের গ্রামীণ সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করে ঘণ্টা দেড়েকেই আমরা পৌঁছে যাই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানে নির্মিত তাঁর সুবিস্তৃত সমাধিপ্রাঙ্গণে। এবং প্রথম দর্শনেই বিস্ময়ে, বিষাদে একেবারে আচ্ছন্ন ও অভিভূত হয়ে পড়ি। এমন অসাধারণ, অনন্য ও অবিশ্বাস্য একটি শ্রদ্ধা-স্থাপনা দুই দশক আগে এই বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, তাও ঢাকার বাইরে দুর্গম একটি গ্রামের মাঝে, বিস্ময়ের কারণ সেটা। আর বিষাদ- যাঁকে নিয়ে, যাঁর মহাকাব্যিক জীবন ও মৃত্যুকে নিয়ে এই বিপুল ও বহুমাত্রিক আয়োজন, তাঁর সারাজীবনের লড়াই-সংগ্রাম, স্বপ্ন-সংকল্প, ত্যাগ-তিতিক্ষা, অর্জন-বিসর্জনের হৃদয় বিদীর্ণ করা আখ্যান ও ইতিহাসের কথা মনে করে। পুরো একটা বেলাই কেটে যায় অমাদের, তিন তরুণ ও মেধাবী স্থপতি এহসান খান, ইশতিয়াক জহির ও ইকবাল হাবিবের নকশা করা, প্রায় চল্লিশ একর জমিতে বঙ্গবন্ধুর জন্মগ্রামকে ঘিরে নির্মিত তাঁর জীবনের শেষতম ঠিকানার সবটুকু ঘুরে দেখতে দেখতে। কী নেই সেই তীর্থভূমিতে।
কাকতালীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুহত্যার একইবছরে প্রয়াত বাবামায়ের কবরের পাশে তাঁর চিরশয়ানের জায়গাটিকে ঘিরে নির্মিত মূল সমাধিগৃহ, তার লাগোয়া তাঁদের সংস্কারকৃত পুরনো বসতবাটি, খানিক দূরে তাঁর পূর্বপুরুষের আদিবাড়ি ও প্রাচীন মসজিদ, ছোট তালাব ও বড় তালাব নামে চিহ্নিত দুটো পারিবারিক পুকুর, বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলার খেলার মাঠ, তার পাশের তরুলতাবেষ্টিত নিস্তরঙ্গ খাল, এমনকি তাঁর প্রিয় বালিশা আমের গাছ ও প্রবীণ কেয়াঝাড়টিকেও সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে নিসর্গ-নিবিড় এই অত্যাশ্চর্য স্থাপনাটিতে। এছাড়া লাইব্রেরি, আর্কাইভ, জাদুঘর, গ্যালারি, অ্যাম্ফিথিয়েটার, শোক-ঝরনা, বাচ্চাদের পার্ক, উদ্যান, উপাসনাগৃহ, পর্যটকদের বিচরণ ও বিশ্রামের জন্য অবারিত মাঠ, বসার জায়গা, প্রবেশ-প্রাঙ্গণ, সবুজের সমারোহ তো রয়েছেই। সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বেড়ে ওঠার গ্রামটিকে কেন্দ্রে রেখে তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব স্থাপনাটি, যা একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর বিশালত্বকে ধারণ করে, অন্যদিকে তেমনি তাঁর ট্রাজিক মৃত্যুর মহিমাকেও যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকের দল তাঁর পরিবারের নিহত সবাইকে ঢাকায় কবরস্থ করলেও তাঁকে এই দূর গণ্ডগ্রামে লোকচক্ষুর অন্তরালে, তড়িঘড়ি ও যেনতেন প্রকারে সমাহিত করে তাঁর স্মৃতি ও অস্তিত্বকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রয়াণের পঁচিশ বছর পরে তাঁরই আত্মজার উদ্যোগে ও নির্দেশনায় নির্মিত এই উদার ও উন্মুক্ত সমাধি-স্থাপনাটি খুনিদের মুখে যেন এক বিশাল চপেটাঘাত। পুরো এলাকাটাই সেদিন ছিল লোকে লোকারণ্য- শ্রেণী, পেশা, ধর্ম, বয়স নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত ও স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধাপ্রদর্শনে উদ্বেল গোটা প্রাঙ্গণ। আমাদের চোখের সামনেই দেখলাম কখনও দলবেঁধে আসছেন গির্জার নানেরা, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সদস্যরা আবার কখনওবা চট্টগ্রাম চারুকলার শিক্ষকদের দল। সত্যিই এ যেন এক মহাতীর্থ, যেখানে এসে ক্রমে মিলে যাচ্ছিল গোটা দেশ ও জাতির সন্তপ্ত সন্তানেরা, তাদের প্রয়াত পিতার চরণে শ্রদ্ধা নিবেদনের নিমিত্তে। এই তীর্থে না এলে জীবন আসলেই বুঝি অপূর্ণ থেকে যেত। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :