মঈন চৌধুরী: মানুষের মন প্রচণ্ডভাবে গতিশীল এবং এই ‘মন’ নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্রবৃত্তির, তাড়না, বিরোধ, গূঢ়ৈষা, অবদমন ইত্যাদির মতো কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থায় অবস্থান করি বিভিন্ন বিরোধ আর বাধাকে গ্রাহ্য করে এবং এর ফলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ স্বাধীন নই। আমাদের চিন্তারও নেই কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। যে কামনা, বাসনা আর যৌন-তাড়না একটি মানুষ বিভিন্ন সামাজিক নিয়মকানুনের জন্য তৃপ্ত করতে পারে না, সেই অতৃপ্তি-জাত ইচ্ছেগুলোকেই অবদমিত হয়ে স্থান করে নেয় মানুষের মনের অচেতন স্তরে। এই অচেতন স্তরেই অবদমনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় এক ধরনের বিপরীতমুখী বিরোধ ও বাধার, যা লজ্জা, ভয়, দুঃখ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মানসিক/মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের যে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি, যার জন্য সে অতৃপ্ত, সেই অবদমিত অতৃপ্তি ও ইচ্ছাগুলোই অচেতন স্তর থেকে স্বপ্ন হয়ে বেরিয়ে আসে।
ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী মনের চেতন ও অবচেতন স্তরের সমন্বয়ে তৈরি হয় একজন ব্যক্তিমানুষের অহং । সামাজিক অহং সবসময বাস্তবতায় নিয়মকানুন মেনে চলে এবং অচেতনে বন্দি কামজ ইচ্ছা/বাসনাকে সমাজ-বাস্তবতায় আসতে দেয় না। ফ্রয়েডের সংশোধিত মতবাদে অহং আংশিক চেতন ও আংশিক অচেতন রূপকে গ্রাহ্য করা হয়েছে। ফ্রয়েড কথিত আংশিক চেতন অহংকে আমরা শুধু অহং হিসেবেই চিহ্নিত করব এবং অচেতন অহংকে বলব অদ। অদ সবসময় সুখসূত্র মেনে চলে; জৈবিক সুখ, কামনা, বাসনা ইত্যাদির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চায় অদ। অদ-এর জৈবিক কামনা, বাসনা ও তাড়না যেহেতু সবসময় সমাজের নিয়মকানুন মানে না, সেহেতু অহং, অদ-এর সব ইচ্ছে পূরণ হতে দেয় না বাস্তবতার সূত্র গ্রাহ্য করে। অদ-এর যে কামনা, বাসনা বা ইচ্ছা সমাজের নৈতিক আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তা অপূর্ণ থেকেই অবদমিত হয়ে অচেতন মনে জমা হতে থাকে। যে অহং বাস্তবতার সূত্র মানে, তাকে ফ্রয়েড অতি-অহং বা অধিসত্তা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
ফ্রয়েড তাঁর মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে মানুষের যৌন-আকাক্ষা, অবদমন এবং শৈশবকালীন যৌনতার বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের আত্মরক্ষামূলক কাজ হলো অহং-প্রবৃত্তি । কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসেবে আমরা সব ধরনের প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুপ্রীতি, আদর, সোহাগ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে পারি। কামপ্রবৃত্তির উপস্থিতি হলো একজন মানুষের জৈবিক সংগঠনের মৌলিক উপাদান এবং এর ফলে একটি শিশুর জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই আত্মকামী সত্তা হিসেবে যৌন-অনুভূতিকেন্দ্রিক কামপ্রবৃত্তির দিকে এগিয়ে যায়। একটি শিশু জন্মের পর নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে গ্রাহ্য করে না এ অবস্থায় সে হয়ে ওঠে এক আত্মকামী নার্সিসাস। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটি কিশোর যখন তার সমবয়স্ক অন্য কোনো কিশোরের ভালোবাসা কামনা করে তখন মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এক ধরনের কামপ্রবৃত্তির সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বলি সমকাম (এরকম যৌনচতনা যদি প্রাপ্তবয়স্ক স্তর পর্যন্ত চেতনায় থাকে তবে তা সমকামী বিষয় হিসেবে গণ্য হয়)।
একটি শিশুর সমলিঙ্গ প্রেম সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে চলে যায় এবং এক সময় তা নারী-পুরুষকেন্দ্রিক যৌন কামনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসেবে আরও কিছু বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছেন ফ্রয়েড, যার মাঝে ইদিপাস এষণা, ইলেকট্রা মর্ষকাম, ধর্মকাম, জীবনবৃত্তি এবং মরণপ্রবৃত্তি উল্লেখযোগ্য। এখানে উল্লেখ্য যে, একজন পুরুষ কিংবা নারী তাদের জৈবিক সত্তা নিয়েই নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে, কিন্তু সমাজের ভাষা ও ভাষা-নির্ভর সমাজ-দর্শন একজন নারীর মন বা মনস্তত্ত্বকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেয়নি। মনে হয়, নারীদের অবমূল্যায়ন করার প্রেক্ষাপটে আছে পুরুষের মনে অবস্থান নেয়া পেশীশক্তির গর্ব, বিকৃত যৌন আকাঙ্খা আর সামাজিক অবক্ষয়। মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং-এর তত্ত্ব অনুসারে মানুষের মন বা মনস্তত্ত্ব ব্যক্তিগত হলেও, একই সমাজ আর পরিবেশে বসবাস করার ফলে 'সামাজিক বা যৌথ' মনস্তত্ত্ব ধারণ করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মন বা মনস্তত্ত্ব সামাজিক নিয়ম মেনে স্বাধীন ভাবেই কাজ করে। সব শেষে বলবো, মন নিয়ে বিস্তারিত জানতে হলে ফ্রয়েড ছাড়াও ইয়ুং, পাভলভ, লাকা প্রমুখের তত্ত্ব সমুহ পাঠ করা উচিত। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :