শিরোনাম
◈ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আইনের খসড়ায় শাস্তির প্রস্তাব ◈ হামাস রাজি থাকলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিবে ইসরায়েল ◈ কুমিল্লায় বিএনপির দু’ গ্রুপের সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ ২ ◈ গফরগাঁওয়ে ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল ◈ পাপুয়া নিউগিনিকে পাঁচ উইকেটে হারিয়ে শুভসূচনা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ◈ এমপি আনার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৩ জনকে বদলি ◈ `প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের পরিবর্তন আনবে' ◈ বুধবার ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা প্রদর্শনে যাবে বিএনপি  ◈ বিমানবন্দরে লাগেজের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে লাখ টাকা জরিমানা ◈ বান্দরবানে বেনজীর পরিবারের একশ একর জমি, রয়েছে খামার ও মাছের প্রজেক্ট 

প্রকাশিত : ১০ মে, ২০২৪, ১২:৫০ রাত
আপডেট : ১০ মে, ২০২৪, ১২:৫০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রবীন্দ্রনাথ : একজন অনন্য এনার্কিস্ট

আহসান হাবিব

আহসান হাবিব: [১] রবীন্দ্রনাথকে আমার একজন এনার্কিস্ট মনে হয়। মনে হয় নয়, তিনি একজন খাঁটি এনার্কিস্ট। তবে তার এনার্কি লোকে বুঝতে পারে না কারণ তিনি তার এই নৈরাজ্য ছড়িয়ে দেন এমনভাবে যে তা রক্ত ঝরায় না  চারু মজুমদার কিংবা সিরাজ শিকদারের মত শ্রেণীশত্রু  খতমের নামে। তার এই এনার্কি কাজ করে বিচিত্র পথে। তিনি একটি শান্ত মনকে অশান্ত করতে পারেন এক পলকে যখন তিনি খুব অনায়াসে বলে ফেলেন যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে। আবার তিনি তার নাটক রক্তকরবীতে একজন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা রাজার সম্পদলিপ্সুর হিংস্র চেহারার স্বরূপ তিলে তাকে ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করেন এবং তার এই লিপ্সাকে হেয় করেন। অর্থাৎ তিনি এখানে পুঁজিবাদবিরোধী একজন প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু পুঁজিবাদবিরোধী হয়েই থেমে যান না, তিনি তার কাঙ্খিত সমাজের রূপরেখাও তুলে ধরেন। সেটা কি? সেটা আর কিছু নয় স্বশাসিত একটি সমাজ যেখানে সকলেই শ্রমে নিযুক্ত থেকে জীবন উপভোগ করবেন। এখানে ভোগের কোন তারতম্য হবে না। এই যে সমাজ নির্মাণ এবং প্রত্যেককে শ্রমের সংগে যুক্ত করা এবং শ্রমবিযুক্ত মানুষকে প্রত্যাখ্যান করা এর চাইতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বাস করে এনার্কি কি হতে পারে? [২] আবার তিনি নির্মাণ নিজস্ব ঈশ্বর যা প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বরের সংগে মেলে না। যখন মেলে না, তখন প্রচলিত ধর্মের লোকেরা ক্ষুব্ধ হয় এমনকি যারা নিরীশ্বরবাদী তারাও বিরক্ত হয়। এই বিরক্তি উৎপাদন করাই একজন এনার্কিস্টের কাজ। তিনি ধর্মকে মোহ বলে তাচ্ছিল্য করেন এবং এই মোহগ্রস্ততাই যে পরস্পরের সংগে বিবাদের কারণ তা জানিয়ে দেন। অর্থাৎ তিনি প্রচলিত ধর্মের বাইরে এমন একটি ধর্মের কথা বলেন যা অতীন্দ্রিয় নয়, ইন্দ্রিয়জাত। কিন্তু তিনি তার ঈশ্বর ধারণাটিকে একটি রহস্যের ঘেরাটোপে রেখে দেন যা একজন মরমী কবির বৈশিষ্ট্য। এই যে তাকে একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধতে না পারা এটাই তাকে এনার্কিস্ট বানিয়েছে। কিন্তু তিনি আবার শ্রেণীশত্রু হয়ে ওঠেন না, তিনি সহনীয় থাকেন, কারণ আগেই বলেছি তিনি তার এনার্কিজন মানুষের মনে এমনভাবে ছড়িয়ে দেন যে তা এলোমেলো করে কিন্তু পথে নামায় না, পরিশীলিত করে কিংবা তার ভাবনার গতিমুখটাকে পাল্টে দেন। তিনি যে ধর্মের কথা বলেন তা হলো মানবধর্ম, ফলে তিনি এখানে ইহলৌকিক এবং বস্তুবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি একটি গানে বলছেন ধর্ম আমার মাথায় রেখে, চলবো সিধে রাস্তা দেখে বিপদ যদি এসে পড়ে সরব না, ঘরের কোণে সরব না এই ধর্ম প্রচলিত ধর্ম নয়, এই ধর্ম মানবধর্ম।

[৩] পরাধীন ভারতে যখন স্বাধীনতার লড়াই চলছে, তখন তিনি একজন স্বাধীনতার যোদ্ধা। তার এই যুদ্ধ সৈনিকের নয়, বুদ্ধিবৃত্তির। কিন্তু তিনি সবসময় রাজনৈতিক নেতাদের সংগে সব বিষয়ে সুর মেলাচ্ছেন না, তিনি প্রবলভাবে বিরোধীতা করছেন। তিনি গান্ধীর সব কর্মসূচি সমর্থন করছেন না। বৃটিশ পণ্য বর্জনের ডাকে তিনি ঐক্যমত পোষণ করছেন না বরং বিরোধীতা করছেন। তিনি পুঁজিবাদের অবাধ প্রতিযোগিতার পক্ষে কথা বলছেন। প্রতিযোগিতা ছাড়া যে বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়বে এই সত্য তিনি রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে বেশি বুঝছেন। এটাই তার প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা। একই সংগে তিনি জাত্যাভিমানকে নাকচ করে দিচ্ছেন। তিনি আন্তর্জাতিকতার পক্ষে কথা বলছেন। এই যে একজন মানুষ নিজের মত প্রকাশ করছেন অন্য সকলের চেয়ে আলাদা এমনকি ভারতীয় নেতৃত্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, এর চেয়ে এনার্কিজম আর কি হতে পারে? তিনি আলটিমেটলি সভ্যতার সঙ্কটের জায়গাটিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন এবং ভোগসর্বস্ব ব্যক্তিগত সম্পদ ও পররাজ্য গ্রাসের নিষ্ঠুরতাকে দায়ী করছেন। এই যে তিনি সবসময় ব্যক্তির বদলে সমাজের সব মানুষের দিকে তাকাচ্ছেন এবং তাদের স্বরাজ কায়েমের কথা বলছেন, তখন তিনি কেবলমাত্র একজন মরমী কবি থাকেন না, হয়ে ওঠেন একজন এনার্কিস্ট। তিনি যখন ইতিহাস নিয়ে কথা বলেন, তখন তা অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে পড়েন। ইতিহাসকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির যে প্রচল তা এক লাইনেই গুঁড়িয়ে দেন। এখানে তিনি খাঁটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি আধিপত্যবাদীদের লেখা ইতিহাসকে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে নিজ অধিবাসীদের লড়াই সংগ্রামের দিকে তাকাতে বলেন যেখানে আসল ইতিহাস লুকিয়ে আছে।

[৪] তিনি যখন গান রচনা এবং সুর করেন, তখন সেখানেও একজন অনন্য রূপকার হিসেবে হাজির হন। মার্গ সংগীতের সমস্ত নির্যাস নিয়ে তিনি যে গান রচনা করেন, তা আগে এবং পরের সব গান থেকে আলাদা হয়ে পড়েন এমনকি তিনি যখন লোকসংগীত থেকে সুর নিচ্ছেন, তখনো।  ফলে তার সংগীত সমাজে একটা আলোড়ন তোলে। একটা আলাদা জেনর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। এখন মানুষ তার গানকে রবীন্দ্রসংগীত বলে। স্রষ্টার নাম নিয়ে আরো অনেকের গান পরিচিতি পেয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত একদম ভিন্ন এবং স্বকীয়তায় ভাস্বর হয়ে ওঠেনি। প্রচলকে ভেঙে নতুন রূপের প্রকাশ এবং তা প্রতিষ্ঠা করা একজন সৃজনশীল  এনার্কিস্টেরই কাজ। সংগীত ছাড়াও তিনি অন্য যত শিল্প মাধ্যমে কাজ করেছেন, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রচলের বাইরে যাওয়া। যেমন নাটক, পেইন্টিং। [৫] এখনো রবীন্দ্রনাথ তার এই এনার্কিজম বহাল রেখেছেন। রবীন্দ্রবিরোধীতা তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। একদল কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোষ্ঠী তার নাম শুনলেই জ্বলে ওঠে, তাকে বাতিল করতে চায়। সারা পাকিস্তান আমল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিপদে ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি বিপদ। কারণ তার ঐ এনার্কিজম যা কালে নিবদ্ধ নয়, কালন্তরে ছড়িয়ে গেছে। লেখক: ঔপন্যাসিক

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়