মোজাফ্ফর হোসেন: সত্যিই কি আমি লেখক? মনে হয় না। লেখক হওয়ার কথা আমার কোনোদিনই ছিল না। আমি যখন বেড়ে উঠেছি, সাহিত্য আমার জীবনের কোনো অংশই ছিল না। ‘লেখক’ বলতে এটুকুই আমার জানা ছিল: রবীন্দ্রনাথ হিন্দু লেখক, পাজি লেখক; নজরুল ইসলাম মুসলমান লেখক, ভালো লেখক। তবে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বানিয়ে বানিয়ে গল্প-কবিতা লেখা লোক কখনো জান্নাতে যাবে না। যাবে না জেনেও কাজী নজরুলের জন্য প্রার্থনা করতাম। আমরা নিশ্চিত জানতাম, রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে পাগল করে দিয়েছেন। কিভাবে তাও জানতাম: ধুতরাফল খাইয়ে। এই ফল খাওয়ানোর জন্য তিনি নিজের মেয়ের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন। নাহলে নিশ্চিত নজরুলই সাহিত্যে নোবেল পেতেন। সাহিত্য সম্পর্কে এই জ্ঞানটুকু আমাদের সকলের মধ্যে ছিল। এতো বড়ো গ্রামে, কেউ কখনো আমাদের এই জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করতে আসেনি। অবশ্য চ্যালেঞ্জ করে লাভও হতো না। রবীন্দ্রনাথ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেননি, এটা চ্যালেঞ্জ করে কোনো লাভ হচ্ছে? তাও শিক্ষিত সমাজে। এই যে ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন আল কোরানের প্রথম অনুবাদক নন’ এই অপপ্রচার করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, বাংলা ভাষায় কোরআন শরিফের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন মৌলভী নাঈমুদ্দীন ১৮৩৬ সালে। অথচ মৌলভী নাঈমুদ্দীন জন্মগ্রহণই করেন ১৮৩২ সালে। চার বছর বয়সে কোরআন অনুবাদ করা যায়? তার পরিবারই বলে গেছে তিনি করেননি। তারপরও লোকজন সেটা না শুনে অন্ধের মতো প্রচার করে যাচ্ছে এই অপপ্রচার। অন্তরের এ অন্ধত্ব এমনই কেউ যদি এখন বলে, রবীন্দ্রনাথের দাদা রসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে আরবে গিয়েছিলেন, তাও আমরা বিশ্বাস করে প্রচার করব। মাঝের প্রায় ১২০০ বছরের ব্যবধান গুরুত্বই পাবে না।
যে কথা বলছিলাম, আমার হাতে তখন কোনো গল্পকবিতার বই ছিল না, ছিল সিহাহ সিত্তাহ। স্কুলে পড়ি, গবেষণা চলে হাদিস নিয়ে। কারণ সমবয়সী বন্ধুরা দুটি ভাগে বিভক্ত। বিভক্ত বাবা-চাচারাও। এই বিভক্তি হিন্দু-মুসলমানে বিভক্তি না। বিভক্তি মুসলমানে-মুসলমানে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে নামাজিতে-নামাজিতে। গ্রামের (শালিকা/মেহেরপুর) একদল হানাফি মাজহাবি অন্যদল আহলে হাদিস। প্রায় সমানে সমান। দুদলের মসজিদ আলাদা, আজান হয় আলাদা সময়ে, নামাজও আলাদারকম। মৃতের জন্য যে জানাজা হয়, সেটিও আলাদা, গোরস্থানও আলাদা। আমি ছিলাম আহলে হাদিস পরিবারের। আমরা রুকুর আগে ও পরে তাকবীরে হাত তুলতাম। ওরা তুলত না। আমরা উচ্চস্বরে আমিন বলতাম, ওরা বলত মনে মনে। আমরা জামাতে নামাজ পড়ার সময় পরস্পর পরস্পরের কাঁধ ও পায়ের গোড়ালি স্পর্শ দাঁড়াতাম, ওরা দাঁড়াত ঢিলেঢালা। আমাদের ঈদের নামাজ ছিল ১২তকবিরের, ওদের ৬ তকবিরের। রমজানে আমরা তারাবি পড়তাম ৮রাকাত, ওরা ২০রাকাত। আমরা বেতের নামাজ পড়তাম ১ রাকাত, ওরা পড়ত ৩। আমরা নামাজ শেষ করে জামাতে মোনাজাত করতাম না, ওরা করত। আমরা শবেবরাতে হালুয়ারুটি খেতাম না, ওরা খেত। আমরা মিলাদ পড়তাম না, ওরা পড়াত। জুম্মাবারে আমাদের খুতবা হতো এক রকমের, ওদের হতো আরেক রকমের।
আহলে হাদিসের কেউ হানাফি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে উচ্চস্বরে আমিন বললে ওরা বিরক্ত হতো। পায়ে পা ঠেকিয়ে দাঁড়াতে গেলে ওরা পা টেনে নিত। বিপরীতে হানাফি কেউ আহলে হাদিসের মসজিদে নামাজ পড়তে এসে উচ্চস্বরে আমিন না বললে আমরা বিরক্ত হতাম। পা যতই টেনে নিক, আমরা ঠ্যাং ফাঁক করে হলেও ওর পা ছুঁয়ে দাঁড়াতাম। এই জেদাজেদি-রেষারেষির কারণে সাধারণত একদল আরেকদলের মসজিদে নামাজ পড়তে যেত না। এই কারণে আমাদের বাড়ির পাশেই বড়ো একটা (হানাফি) মসজিদ থাকা স্বত্বেও আমার আব্বারা মিলে আমাদের বাড়ির দরজার মুখে আরেকটা মসজিদ তৈরি করেন। এক তরিকার লোক আরেক তরিকার মসজিদে দানখয়রাত করত না, এক তরিকার মসজিদ থেকে আরেক তরিকার দরিদ্রদের জাকাত দিত না। আমরা ছিলাম পীরতন্ত্র, মাজারপন্থা, সুফিবাদ, তাবলীগ জামাতের ঘোর বিরোধী। কিন্তু ওদের পীরে আস্থা ছিল, তাবলীগ জামাতে যেত।
ধর্মীয় আচার সংস্কারেও আমরা ছিলাম বিভক্ত। আমাদের আমিরের পরিবারের কোনো সন্তান অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়াশুনা করেনি। কারণ তখন সম্ভবত নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন হতো বলে ছবি তুলতে হতো। ছবি তোলা পাপ। কাজেই সন্তানদের পড়ালেখা ঔ পর্যন্তই। এরপরও ছবি তুলে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে ভেবে আমাদের মনে দুঃখবোধ হতো। এই দুঃখবোধ আবার হানাফিদের মনে ছিল না। ছেলেমেয়ে বিয়ের ক্ষেত্রেও সমধর্মিতা গুরুত্ব পেত। তখন সিহাহ সিত্তাহ নিয়ে পড়ে থাকার কারণ, আমরা যা করি সেগুলোর পেছনের হাদিসগুলো খুঁজে খুঁজে মুখস্থ রাখা। হানাফি বন্ধুদের শুনিয়ে কাত করে দেওয়া। ‘তোর তো নামাজই হয় না’, এইটা ছিল আমাদের পরস্পর পরস্পরকে দেওয়া আল্টিমেট গালি। আমাদের ইমাম বলতেন, কেয়ামতের আগে খোদ কাবা ময়দানে শত শত ভাবে নামাজ পড়া হবে। এর মধ্যে একদল মুসলমানই বেহেশতে যাবে, যারা শুদ্ধভাবে নামাজ আদায় করবে। আমরা একমাত্র শুদ্ধভাবে নামাজ আদায় করি এ ধারণা থেকে নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠতর’ মুসলমান ভাবতাম। আমাদের কাছে মনে হতো, পৃথিবীর একমাত্র সহি ইবাদত হলো, সহিভাবে নামাজ পড়া। সিহাহ সিত্তাহর মধ্যে আবার আমরা সবগুলোকে গুরুত্ব দিতাম না। অধিকাংশ হাদিস জাল বা দুর্বল হাদিস বলে আমাদের আমির উড়িয়ে দিতেন। আমরা বুখারী (১ থেকে ১০ খণ্ড), মুসলিম (সকল খণ্ড), তিরমিযী (সকল খণ্ড) ক্রনাম্বয়ে গুরুত্ব দিতাম। সুনানে ইবনে মাজাহ (সকল খণ্ড), আবু দাউদ (সকল খণ্ড) সুনানে নাসাঈ (সকল খণ্ড) কম গুরুত্ব দিতাম। বুখারীর অনেক হাদিস (যেগুলো আমাদের মতাদর্শের সঙ্গে যেত না) দুর্বল বা জাল বলে দাগিয়ে রাখতাম। মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় আমি আর আমার বোনের ছেলে আরিফ রাতদিন গবেষণা করে আহলে হাদিসের পক্ষের ডকুমেন্টস (হাদিস) একত্রে করি। আরিফের বাপ-চাচারা হানাফি হলেও সে আহলে হাদিসের অনুসারী হয়ে যায়। এটা তখন আমাদের কাছে বিরাট ঘটনা। কনভার্ট হওয়ার মতো ব্যাপার।
এই সময়ে যারা (প্লাস আমার অন্য ধর্মের বন্ধুরা) মাজহাব সম্পর্কে কম জানেন তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে বলি। মাজহাব হল ইসলামি ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এক একটি চিন্তাগোষ্ঠী ও চর্চাকেন্দ্র। নবী মুহাম্মদ (স.)-এর ইসলাম প্রচারের পর আনুমানিক প্রায় দেড়শত বছরের মধ্যে অনেক মাজহাবের উৎপত্তি হয়। চারটি প্রাথমিক সুন্নি মাজহাব হচ্ছে: হানাফি, শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি।
হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা। তিনি ফিকহশাস্ত্রের উদ্ভাবক। এই শাস্ত্রের মাধ্যমে কুরআন ও হাদিসের আলোকে ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন বিধি-বিধান ও ইসলামি সমাধান জানা যায়। তাকে অ-আরবীয় বলে ধরা হয়ে থাকে। ইমাম বুখারির ওস্তাদ মক্কি বিন ইবরাহিম ছিলেন আবু হানিফার ছাত্র। মালেকি মাজহাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মালেক ইবনে আনাস। শাফেয়ি মাজহাবটি মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আশ-শাফেয়ি প্রতিষ্ঠা করেন। হাম্বলি মাজহাব প্রতিষ্ঠা পায় আহমদ বিন হাম্বলের হাত ধরে। এই চার ইমামের মধ্যে ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল। ইমাম আবু হানিফার ছাত্র হলেন ইমাম মালেক। মালেকের ছাত্র ইমাম শাফেয়ি এবং তাঁর ছাত্র ইমাম আহমদ বিন হাম্বলি।
এনিওয়ে, প্রসঙ্গে আসি। আমার বেড়ে ওঠা হিন্দু-মুসলিম না, আন্তঃধর্মীয় দ্বিধাবিভক্তির মাঝে। কিন্তু এও ঠিক, গ্রামে একঘর হিন্দু না থাকলেও, হিন্দু-মুসলিম বিভেদের যে রাজনীতি তা থেকে আমরাও বাইরে ছিলাম না। আজ ভারতের আধিপত্যবাদী চরিত্রের যে সমালোচনা করা হয়, এসব কিছু না বুঝে, না জেনেও ভারতবিদ্বেষ আমাদের মধ্যে ছিল। সাম্প্রদায়িকতার কাছে কোনো যুক্তির প্রয়োজনও হয় না। গ্রামে কোনো হিন্দু ছিল না যে আমাদের সাম্প্রদায়িক আচরণের শিকার হবে। তার মানে কি আমরা সাম্প্রদায়িক আচরণ করিনি? অবশ্যই করেছি। আমরা লাল পিঁপড়ে টিপেটিপে মেরেছি, ওরা ভারতীয়, ওরা হিন্দু, এই ভেবে। আমরা কালো পিঁপড়েদের যত্ন করেছি, কারণ তারা মুসলমান। কালো পিঁপড়েদের ভারতীয় হিন্দুরা টিপেটিপে হত্যা করে ভেবে দুঃখবোধ হয়েছে আমাদের। যার মনে বিষ, সে অন্যের মনেও বিষ খোঁজে। সাম্প্রদায়িকতা এমনই। মুক্তিযুদ্ধের কথা জেনেও আমরা তখন পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সাপোর্ট করেছি। সেও সাম্প্রদায়িকতার কারণেই। সাম্প্রদায়িকতার কারণ ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধত্ব। সেই অন্ধত্বের কারণেই হিজড়া ট্রান্সজেন্ডার এদের মানুষই মনে করিনি। সবকিছুর ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর চেয়েও নিজেকে বড়ো সিদ্ধান্তগ্রহীতা হিসেবে মনে করেছি।
স্বয়ং নবীর চেয়েও নিজেকে বেশি মুসলমান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার রেইসে রাতদিন দৌঁড়ে গেছি। বিষয়টা এমনই, একটা উদাহরণ দিই, আমার এক বৃদ্ধ চাচা একদিন একটা ফতোয়া দিলেন। আমরা বললাম রসূল কোথাও এটা বলেননি। দুর্বল/জাল কোনো হাদিসে নেই। তিনি তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমি পঁচাত্তর বছর ধরে নামাজ পড়ছি। জীবনে নবীর চেয়ে বেশি নামাজ পড়েছি। আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস না।’ ফলে, আজ যারা আমাকে গালি দেয় আমি সাম্প্রদায়িকতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলি বলে, আমার তো কথা ছিল তাদেরই সঙ্গে থেকে আজ অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বের লোকগুলোকে গালিগালাজ করা। আমার মধ্যে কে তুলে দিলো এই বিপরীত চেতনা? কোনো লেখক? আমি তো সাহিত্যের পাঠকই ছিলাম না। তাহলে? সাম্প্রদায়িকতাই আমাকে শিখিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। ধর্মীয় গোঁড়ামিই আমাকে শিখিয়েছে ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে কথা বলা। ধর্মীয় বিভেদ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও জাতিগত মিথ্যাচারের মধ্যেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, কাজেই সেসবের বিরুদ্ধে কথা বলার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে। হুজুর, এটাই আমার ধর্ম। যদি মুসলমান হই, এটাই আমার ইসলাম। আপনি আমাকে গালি দিলে আমার হাসি পায়, বড়জোর আপনার নোংরা কলুষিত অন্তরের কথা ভেবে করুণা হয়। এর বেশি কিছু হয় না। অন্ধকার থেকে আলোয় আসার আনন্দ যে পেয়েছে, কেবল সেই বুঝবে এটা।
হুজুর, আসেন একটা মোনাজাত ধরি হে মহান আল্লাহ, আপনি জীব ও জড়ো সকলের প্রভু, অন্তর্যামী। আপনি সকল প্রাণ ও অপ্রাণের মঙ্গল করুন। আমাকে জাতি-ধর্ম-বিত্ত-জেন্ডার ভুলে সকল মানুষকে এবং প্রাণীকুলকে ভালোবাসার তৌফিক দান করুন। যদি সত্যিই কিছু পুণ্য করে থাকি, এক যাররা পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকি, তার বিপরীতে এটাই আমার একমাত্র প্রার্থনা। আমিন। লেখক: কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :