আবুল কালাম আজাদ: ২০১১ সালের জাপানের তোহোকু ভূমিকম্প পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াল এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পে যখন প্রশান্ত মহাসাগরের তীর কাঁপছিল, পুরো দেশের মানুষের মনেও যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সেই ভয়াবহতার মাঝেও এক অদ্ভুত দৃশ্য বিশ্বের মানুষকে অবাক করে দেয়। টোকিওর রাস্তায় তখনো গাড়ি চলছিল, হাসপাতালে অপারেশন থামেনি, আর যেসব আধুনিক ভবনে বেস আইসোলেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল—সেসব ভবনের ভেতরে টেবিলে রাখা কাচের গ্লাস পর্যন্ত ভাঙেনি। যেন ভয়াবহ ভূমিকম্পের শক্তি মাটির গভীরে কোথাও শোষিত হয়ে গেল, উপরের ভবনগুলোকে ছুঁতেও পারল না।
কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এমন দৃশ্য? কীভাবে একটি দেশ যেটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প–প্রবণ, সেটিই বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ উচ্চ–ভবনের দেশ হয়ে উঠল? এর উত্তর একটাই—বেস আইসোলেশন, অর্থাৎ ভবন আর মাটির মাঝখানে একটি বৈজ্ঞানিক সুরক্ষা স্তর। আমরা প্রচলিতভাবে ভাবি ভবন যত বেশি শক্ত করে মাটির সাথে বাঁধা থাকবে, তত বেশি নিরাপদ হবে। কিন্তু ভূমিকম্পের বিজ্ঞান বলছে উল্টো কথা—মাটি যখন প্রচণ্ডভাবে কাঁপে, সেই শক্তি যদি সরাসরি ভবনের কাঠামোতে প্রবেশ করে, তবে সবচেয়ে শক্ত ভবনও ভেঙে পড়তে পারে। তাই জাপান বেছে নিয়েছে ভিন্ন পথ: ভবনকে শক্ত করে বেঁধে না রেখে, বরং ভবনকে মাটির সাথে আলাদা করার প্রযুক্তি।
এই “বেস আইসোলেশন” বলতে বোঝায় ভবনের বেজমেন্টের নিচে শত শত রাবার-লেড বেয়ারিং বসানো হয় যেগুলো ভূমিকম্পের ধাক্কা শুষে নেয়। ভূমিকম্প হলে মাটি হয়তো অনেকটা সামনের দিকে–পেছনের দিকে দুলবে, কিন্তু ভবনটি ধীরে–ধীরে দুলবে, কোনো আকস্মিক ধাক্কা ভবনের কাঠামোয় পৌঁছাতে পারবে না। ফলে ভবনের ভেতরে থাকা মানুষ, যন্ত্রপাতি, হাসপাতালের অপারেশন রুম, সার্ভার রুম, স্কুলের ক্লাসরুম—সবই প্রায় ক্ষতিহীন থাকে। জাপান দেখিয়েছে বেস আইসোলেশন শুধু স্থাপত্যের প্রযুক্তি নয়; এটি মানুষের জীবনরক্ষার অন্যতম শক্তিশালী ঢাল।
আজ জাপানের নতুন প্রায় সব ভবনেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। শুধু নতুন ভবন নয়, ৪০–৫০ বছরের পুরোনো ভবনও কেটে–কেটে নিচে নতুন বেয়ারিং বসিয়ে পুনর্জীবন দেওয়া হচ্ছে। কারণ একটি ভবন ধসে পড়ার ক্ষতি শুধু সম্পত্তি বা টাকা-পয়সার ক্ষতি নয়; এটি একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলো জানে কোনো উন্নয়নই নিরাপত্তার চেয়ে বড় নয়।
বাংলাদেশও এখন সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছে—এটি অবশ্যই আশার কথা। BNBC-2020 অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ ভবনে বেস আইসোলেশন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে, মেট্রোরেলের কিছু স্টেশনে, এবং ঢাকার কয়েকটি নতুন টাওয়ারে এই প্রযুক্তি ব্যবহার ইতোমধ্যেই স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এতেই কি আমাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত? সম্ভবত নয়। কারণ বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম নাজুক অঞ্চল। বিশেষ করে ঢাকা শহর। মানুষের অযাচিত ঘনত্ব, নিরাপত্তাহীন ভবন, অপরিকল্পিত নির্মাণ—সব মিলিয়ে সামান্য একটি বড় ভূমিকম্পও ঢাকার চেহারা পাল্টে দিতে পারে।
শুধু একটি উদাহরণ যথেষ্ট। ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পে যখন পুরো দেশ কেঁপে উঠল, সেই শক্তি প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার দূরের ঢাকাতেও অনুভূত হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ডের দোলায় ঢাকার বহু পুরোনো ভবনের দেয়ালে ফাটল সৃষ্টি হয়। যদি এমন ভূমিকম্পের কেন্দ্র কখনো বাংলাদেশে হয়? বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন—বাংলাদেশে ৮ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস আছে এবং ভবিষ্যতেও সে সম্ভাবনা রয়ে গেছে। বাংলাদেশে যেসব ফাল্ট লাইন রয়েছে, যেমন মধুপুর ফাল্ট বা ডাউকি ফাল্ট, সামান্য নড়াচড়াতেও বিশাল ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ কারণে এখনই ভবন নির্মাণে বেস আইসোলেশনের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু প্রাযুক্তিক উন্নয়ন নয়, এটি জীবন বাঁচানোর বিনিয়োগ।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখা যায় বাংলাদেশের নগরায়ন দ্রুত বাড়ছে। ঢাকায় উঁচু ভবন তৈরির হিড়িক চলছে; কমার্শিয়াল টাওয়ার, হাসপাতাল, ডেটা সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিংমল—সবকিছুই উচ্চতর ও বৃহৎ আকারে নির্মিত হচ্ছে। এই সব ভবনে বেস আইসোলেশন এখনই বাধ্যতামূলক না হলে ভবিষ্যতের ঝুঁকি আরও বাড়বে। বিশেষ করে হাসপাতাল ও ডেটা সেন্টার—যেখানে প্রাণরক্ষা এবং তথ্য নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—এসব প্রতিষ্ঠানে ভূমিকম্পের সময় সিস্টেম চালু থাকা অপরিহার্য। জাপান দেখিয়েছে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও হাসপাতাল সেবা চালু রাখা সম্ভব, যদি ভিত্তি প্রযুক্তি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যখন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ধসে পড়ে। এতে একসাথে বহু মানুষের প্রাণ যেতে পারে। বেস আইসোলেশন প্রযুক্তির ব্যবহার স্কুল–কলেজে বাধ্যতামূলক না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন। এ ছাড়া সার্ভার রুম, ডেটা সেন্টার, টেলিকম টাওয়ার—এসব জায়গায় ভূমিকম্পে ক্ষতি হলে পুরো দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো বিপর্যস্ত হতে পারে। তাই আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা অনুযায়ী নিরাপত্তা অবকাঠামো শুধু ভবনের শক্তি নয়, ভবনের নমনীয়তা এবং শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বেস আইসোলেশন প্রযুক্তির আরেকটি বড় সুবিধা হলো এটি ভবনের আয়ু বাড়িয়ে দেয়। প্রচলিত ভবন কাঠামো ভূমিকম্পে ফাটল ধরে দুর্বল হয়ে যায়, পরবর্তী বড় ভূমিকম্পে ধসে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু বেস আইসোলেশন সেই ধাক্কাকে অনেকটাই শোষণ করে নেয়, ফলে ভবনের কাঠামোতে চাপ কম পড়ে। এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক, কারণ বড় ভূমিকম্পের পর মেরামতের ব্যয় বা ভবন প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় কিছুটা বেশি হলেও প্রয়োজনে বিদেশি উদাহরণগুলো আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে এটি বহুগুণ সাশ্রয়ী।
অনেকেই ভাবতে পারেন—বেস আইসোলেশন কি শুধুই উন্নত দেশের প্রযুক্তি? মোটেও না। বিশ্বের মাঝারি আয়ের বহু দেশই ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছে। তুরস্ক, চিলি, মেক্সিকো, ইতালি—আধুনিক বেয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূমিকম্পের ক্ষতি নাটকীয়ভাবে কমিয়ে এনেছে। এদের অভিজ্ঞতা বলে—যেখানে ভূমিকম্প প্রবণতা বেশি, সেখানে ভবনের শক্তি বাড়ানোর চেয়ে বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ শক্তি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করা বেশি কার্যকর।
বাংলাদেশে ভবন নির্মাণের মান উন্নয়নে BNBC-2020 অবশ্যই একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু আইন থাকলেই যথেষ্ট নয়; প্রয়োগ থাকতে হবে কঠোরভাবে। বাস্তবে দেখা যায়, অনেক নির্মাতা এখনও উচ্চ ভবন তৈরি করতে গিয়ে সঠিক প্রকৌশল মান বজায় রাখেন না। তারা দ্রুত নির্মাণ, কম খরচ এবং লাভের চিন্তায় নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে চান না। এই মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। কারণ একটি মানুষের জীবনও অমূল্য। ভবন ধসে পড়ে শত মানুষের জীবন হারালে যে ক্ষতি হয়, তার সঙ্গে কোনো অর্থমূল্য তুলনা চলে না। তাই সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে আইন কঠোর করতে হবে, আর জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে? এর উত্তর দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। আজকের উন্নয়নযাত্রা শুধুই flyover, expressway, মেট্রোরেল নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আমাদের উন্নয়নকে টেকসই হতে হবে। ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় বা বন্যা—যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকতে পারে এমন অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ঠিক এই পথেই এগিয়েছে। উন্নয়ন মানেই নিরাপদ উন্নয়ন।
জাপানের উদাহরণ আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট শিক্ষা রেখে গেছে—দুর্ঘটনা থেকে শিখতে বসলে অনেক দেরি হয়ে যায়। তখন প্রযুক্তি আপনাকে বাঁচাতে পারে না, কারণ ভেঙে পড়া ভবন আবার দাঁড় করানো যায়, কিন্তু ফিরে পাওয়া যায় না সেই মানুষগুলোকে যারা ছিল ভবিষ্যতের দায়িত্ব। মানুষ বাঁচানোই উন্নয়নের প্রথম শর্ত। আর বেস আইসোলেশন সেই নিরাপত্তার প্রথম ধাপ।
আমাদের উচিত এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া—সব নতুন ভবনে বেস আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করা, পুরোনো গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো পর্যায়ক্রমে রেট্রোফিটিংয়ের আওতায় আনা, প্রকৌশলী ও স্থপতিদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেওয়া, এবং জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের মানুষের জীবন এখন আগের চেয়ে অনেক মূল্যবান। আমাদের দেশ এগোচ্ছে, শহর এগোচ্ছে, শিল্পায়ন বাড়ছে—তাই আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উন্নত হতে হবে।
জাপানে আজ যে টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে নিরাপদে, সেটি শুধু কংক্রিট বা ইস্পাতের ওপর দাঁড়িয়ে নেই—দাঁড়িয়ে আছে তাদের দূরদৃষ্টি, প্রযুক্তির প্রতি আস্থা, এবং মানুষের জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার ওপর। বাংলাদেশও সেই পথেই হাঁটছে। আশা করা যায়, আমরা প্রযুক্তিকে বিলাসিতা নয়, জীবনরক্ষার অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে দেখতে শিখব।
আমাদের যেন কখনো শিখতে না হয় দুর্ঘটনা থেকে। বরং শেখা উচিত পূর্বপ্রস্তুতি থেকে, জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা থেকে, বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে। নিরাপদ বাংলাদেশ শুধু আমাদের নয়—আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি দায়িত্ব, একটি অঙ্গীকার। ভবিষ্যতের শহর হবে সেই শহর—যেখানে ভূমিকম্প মানেই আতঙ্ক নয়, বরং প্রস্তুত অবকাঠামোর ওপর আস্থা। যেখানে মানুষ বিশ্বাস করতে পারবে তার বাড়ি, তার অফিস, তার স্কুল তাকে রক্ষা করবে। আর সেই ভবিষ্যৎ গড়তে দরকার বেস আইসোলেশনের মতো আধুনিক প্রযুক্তি—যা আমাদের জীবনকে দেবে নিরাপত্তা, দেবে টেকসই উন্নয়নের নিশ্চয়তা।
আবুল কালাম আজাদ , যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিষ্ট, columnistazad@gmail.com