বিশ্বে এমন এক পরিবার রয়েছে, যাদের অর্থনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার জালে নাকি ইউরোপ ও আমেরিকার বহু প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতা পর্যন্ত নীরবভাবে পরিচালিত হয়েছেন। ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, গত কয়েক শতাব্দীর যুদ্ধ, সংকট, শান্তি কিংবা আন্তর্জাতিক কূটনীতির আড়ালে অদৃশ্যভাবে কলকাঠি নেড়ে এসেছে রথচাইল্ড পরিবার—বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও রহস্যময় এক বংশ।
এত প্রভাবশালী হয়েও পরিবারটির সদস্যরা সচরাচর জনসমক্ষে আসেন না, মিডিয়ায়ও নেই তেমন সরব উপস্থিতি। তবুও ব্যাংকিং, জ্বালানি, খনিজ, রিয়েল এস্টেট, ঔষধ, প্রযুক্তিসহ বহু খাতে তাদের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসে।
এই সাম্রাজ্যের সূচনা করেন মায়ার আমশেল রথচাইল্ড।
১৭৪৪ সালে জার্মানির এক ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া মায়ার অল্প বয়সেই বাবা-মাকে হারিয়ে হ্যানোভার শহরের একটি ব্যাংকে শিক্ষানবিশ হন। সেখান থেকে আর্থিক কৌশল, সুদের হিসাব এবং বিনিয়োগের ব্যবসায়িক রসদ শিখে ফিরে আসেন ফ্রাঙ্কফুর্টে।
ইহুদি মহল্লায় একটি ছোট ব্যাংক খোলার মাধ্যমেই শুরু হয় রথচাইল্ডদের অর্থনৈতিক প্রভাবের পথচলা। বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও আচরণে দ্রুত রাজপরিবার ও সম্ভ্রান্তদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি।
মায়ারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন রাজা উইলিয়াম। রাজপ্রাসাদের অগোচরে পুরোনো শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে ইউরোপে উচ্চদামে বিক্রি করার মাধ্যমে বাড়তে থাকে তার মূলধন ও প্রভাব।
নেপোলিয়নের ফ্রান্স ইউরোপজুড়ে আক্রমণ শুরু করলে পালিয়ে যাওয়ার আগে রাজা উইলিয়াম বিপুল অর্থ মায়ারের কাছে জমা রাখেন। এ অর্থ কাজে লাগিয়ে মায়ার তার চার ছেলেকে পাঠান ইউরোপের চার গুরুত্বপূর্ণ শহরে—
* লন্ডন
* প্যারিস
* ভিয়েনা
* নেপলস
প্রত্যেক ছেলেকে নির্দেশ দেওয়া হয় আলাদা মার্চেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার। আর ফ্রাঙ্কফুর্টের দায়িত্ব সামলান অপর ছেলে।
পরিবারের সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন নাথান রথচাইল্ড। তিনি লন্ডনে এন এম রথচাইল্ড অ্যান্ড সন্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ইংল্যান্ড–ফ্রান্স যুদ্ধের সময় নাথান প্রকাশ্যে ব্রিটিশ সরকারকে অর্থ সহায়তা করলেও গোপনে নেপোলিয়নের কাছেও ঋণ দিয়ে দুই পক্ষই নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
যুদ্ধ শেষ হলে বিধ্বস্ত রাষ্ট্রগুলো পুনর্গঠনের জন্য আবার ঋণ দিয়ে ব্যবসায়িক লাভ নিশ্চিত করতেন রথচাইল্ডরা। ইতিহাসবিদদের মতে—
“যুদ্ধই ছিল রথচাইল্ডদের সবচেয়ে বড় পুঁজি।”
ঋণ প্রদান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনার অভিজ্ঞতা ইউরোপ ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় আমেরিকায়। ১৮১২ সালের ব্রিটেন–আমেরিকা যুদ্ধের পেছনে রথচাইল্ডদের ভূমিকার কথাও ইতিহাসে পাওয়া যায়।
যুদ্ধোত্তর আমেরিকাকে স্থিতিশীল করতে ১৮১৬ সালে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়, তার বড় বিনিয়োগকারীও ছিলেন নাথান রথচাইল্ড।
পরবর্তীতে রাশিয়া–জাপান যুদ্ধেও রথচাইল্ডদের ব্যাংক বিপুল অঙ্কের অর্থ ধার দেয় জাপানকে, যুদ্ধ বন্ড বিক্রি করে রাতারাতি লাভ করে কোটি কোটি টাকা।
দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে—
* ব্যাংকিং
* খনিজ
* জাহাজ
* রিয়েল এস্টেট
* রাজস্ব ব্যবসা
* সোনা–হীরা
* হোটেল
* ফার্মাসিউটিক্যাল
* প্রযুক্তি
সহ শতাধিক খাতে ব্যবসা রয়েছে এই পরিবারের।
তবুও রহস্যময় কারণেই পরিবারটির সদস্যদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন চোখে পড়ে। জনসমক্ষে খুব কমই দেখা যায় তাদের। সমাজসেবামূলক ও আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রাম ছাড়া মিডিয়ায় উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
বিশ্লেষকদের মতে, নীরবে কাজ করাই রথচাইল্ড পরিবারের শক্তি। প্রকাশ্যে না এলেও বহু যুগ ধরেই এই পরিবার আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও কূটনীতি—উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
সূত্র: জনকণ্ঠ