মহসিন কবির: ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস আতঙ্কে অনেক মানুষই ঢাকা ছেড়েছিলেন। কারণ তখর ঢাকা ছিলো মৃত্যুর নগরী। হাসতালগুলোতে ছিল লাশের সারি। ঢাকার পাড়া-মহল্লায় ছিলো লগডাইন। বাঁশ দিয়ে আটকোনো। সাধারণভাবে চলাফেরা করা যাচ্ছিলো না। মানুষের আয়-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় দেশে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। এবার ভূমিকম্প আতঙ্কে ঢাকা ছাড়ছেন মানুষ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় বাড়িতে গেছেন শিক্ষার্থীরা।
সরকারি চাকরি থেকে বছর দুই আগে অবসর নেন মুজিবুর রহমান। উন্নত চিকিৎসা সুবিধার কারণে জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় না গিয়ে থিতু হয়েছেন ঢাকার তিলপাপাড়া এলাকায়। ভূমিকম্প-ঝুঁকির কারণে এখন তিনি ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে।
ঢাকার আরেক বাসিন্দা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ, যিনি মিরপুর-১ নম্বরে সপরিবারে বসবাস করছেন। তিনি জানান, শুক্রবার সকালে ভূমিকম্পের পরপরই তার আতঙ্কিত সন্তানরা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার বায়না ধরেছে। বুলবুলের স্ত্রীও গ্রামে যাওয়ার পক্ষে। এখন তারা সুবিধামতো সময়ে রাজধানী ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন।
শুধু মুজিবুর কিংবা বুলবুল আহমেদ নন, বসবাসের অনুপযোগী যান্ত্রিক এ শহরের অনেকেই নিজ জেলায় অথবা অন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তা করছেন এখন। নানান অসুবিধা সহ্য করে বিভিন্ন কারণে বাধ্য হয়ে থাকা এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ভূমিকম্পের পর যে বড় ভয় ঢুকেছে, তা ঢাকা ছাড়ার পুরনো ইচ্ছে আরও তীব্র হয়েছে।
এ ভূখ-ে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের নজির থাকলেও শুক্রবারের মাঝারি মাত্রার যে ভূমিকম্প পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল, এমন প্রাণঘাতী ভূমিকম্প গত কয়েক দশকের মধ্যে দেশের মানুষ আর দেখেনি। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ২৬ সেকেন্ড স্থায়ী ওই ভূমিকম্পে অন্তত ১০ জন নিহত এবং আহত হয়েছে বহু মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক ভবন ও স্থাপনা। কম্পনের স্থায়িত্ব আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বেশি হলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা ছিল।
চরম আতঙ্কের মধ্যেই পরদিন শনিবার দুপুর ও সন্ধ্যায় রাজধানীতে তিন দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যদিও নতুন এসব ভূমিকম্পে কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবুও নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এটিকে বড় ভূমিকম্প আসার আগাম বার্তা হিসেবেও দেখছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। তবে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় খোলা মাঠের ব্যবস্থা করা, নির্মাণ বিধিমালা মেনে ভবন নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনে সেগুলো সংস্কার কিংবা ভেঙে ফেলা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সেই সঙ্গে রাজধানীবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপরও ভূমিকম্প হলে তাৎক্ষণিক করণীয় বিষয় নিয়ে পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিক আমীন আল রশীদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘গত দুদিনের ভূমিকম্পে আমার স্ত্রী এতটাই আতঙ্কিত যে, সে বারবার বলছে চলো বাড়ি চলে যাই। শুরুতে ভাবছিলাম এটা তার কথার কথা। এখন দেখছি, না; এটা সে সিরিয়াসলিই বলছে। এমনকি আমি চাকরি না করলে কীভাবে সংসার চলবে সেই প্রশ্নের উত্তরে আমাকে জিজ্ঞেস করছে পত্রিকায় লেখালেখি করে কত পাওয়া যাবে? তারপর সে মনে করছে, আমি যদি ফরমাল চাকরি বাদ দিয়ে ইউটিউবে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কনটেন্ট বানাই, তাহলেও নাকি আমার বেতনের কাছাকাছি উপার্জন হয়ে যাবে।’
‘ভূমিকম্প আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে, বিশেষ করে মনোজগতে এই যে বিরাট পরিবর্তন এনে দিল; এই যে বিরাট একটা ধাক্কা দিল, তা সামাল দেয়া যাবে কীভাবে? ভূমিকম্প আতঙ্কে সত্যিই কি অসংখ্য মানুষ ঢাকা ছেড়ে তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ শহর যেমন বরিশাল ও খুলনায় চলে যাবে?’ এমন প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
তার ওই পোস্টের নিচে ঢাকার আরেক বাসিন্দা শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরার মন্তব্য ‘আম্মু শুক্রবার থেকে বারবার বলছে, চলো খুলনা চলে যাই। আমাদের একতলা বাড়ি। দৌড় দিয়ে বের হয়ে সামনের রাস্তায় দাঁড়াতে পারব।’
কেউ আবার ভিন্নমতও পোষণ করেছেন। তাদেরই একজন প্রকৌশলী সোহেলী সুলতানা মৌরি। তিনি বলেন, ‘প্রশ্নটা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে, কেউ কেউ ভয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে ঢাকা ছাড়ছে, কেউবা আবার ছাড়তে চাইছে। কিন্তু এটা কি কোনো সমাধান হতে পারে? মৃত্যু থেকে কি কেউ দূরে সরে যেতে পারে একটা জেলা ছেড়ে? এরা এক কাজ করুক, মহাশূন্যে চলে যাক। ওখানে ভূ নেই, তাই তার কম্পনও নেই।’
নানা কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বেশিরভাগ বাসিন্দাই ঢাকা ছাড়তে চান। সমস্যা হলো ঢাকার মতো অন্য জেলায় কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে খুবই কম। ফলে ইচ্ছে থাকলেও অনেকেই রাজধানী ছাড়তে পারেন না। আবার ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ নিজের এলাকায় গিয়ে বেশ ভালোই সময় পার করছেন।
তরুণ উদ্যোক্তা প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক বলছিলেন, ‘ঢাকার বাইরে যদি উপার্জনের কোনো উপায় থাকত, তাহলে আমি এখান থেকে চলে যেতাম এবং আর কখনো ফিরে আসতাম না।’
মিরপুর-১ নম্বরের বিহারিপাড়ার বাসিন্দা সাদেকুর রহমান কামাল বলেছেন, ‘ভূমিকম্পের পর একপ্রকার মানসিক রোগী হয়ে পড়েছি। এটি সবসময় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি ঘুমের মধ্যেও মাঝেমধ্যে ভয়ে আঁতকে উঠছি। ঢাকা শহর এমনিতেই বসবাসের অনুপযোগী। এখন ঢাকায় থাকা না থাকা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।’
দেশের কোন জেলা কতটা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে, তা চিহ্নিত করতে তিনটি জোনে ভাগ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এগুলো হলো জোন-১ (উচ্চঝুঁকি), জোন-২ (মাঝারিঝুঁকি) এবং জোন-৩ (নিম্নঝুঁকি)।
সে হিসেবে ঢাকা জোন-২-এ অর্থাৎ মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু ভবন নির্মাণ বিধিমালা না মেনে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মাঝারি ঝুঁকির তালিকায় থেকেও ঢাকায় ভূমিকম্পে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরপর দুদিনে চার দফা ভূমিকম্পে পুরান ঢাকা ও বংশালের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কারণ, সেখানকার ভবনগুলো বেশ পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। বাসিন্দাদের অনেকেই নিরাপদ স্থানের খোঁজ করছেন।
মিটফোর্ড এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘এখানকার ভবনগুলো পুরনো এবং একটার সঙ্গে আরেকটা অনেকটা লাগোয়া। দুর্ঘটনা ঘটলে নিরাপদে কোথাও দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। এখানে বড় ভূমিকম্প হলে কী যে হবে, তা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন।’ উদ্বেগের কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বড় ভূমিকম্প হতে পারে সেই আশঙ্কায় মহা চিন্তায় আছি। ভাবছি যত দ্রুত সম্ভব গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ চলে যাব।’
৫ বছরে ১৮ জেলায় ভূমিকম্প, বেশিরভাগই রাতে : গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৩৯টি ভূমিকম্প হয়েছে। যে ১৮ জেলায় এই ভূমিকম্প হয়েছে সেগুলো হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, সিলেট, নেত্রকোনা, দিনাজপুর, হবিগঞ্জ, রংপুর, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, পাবনা, হবিগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, চুয়াডাঙ্গা, শরীয়তপুর, যশোর ও কুড়িগ্রাম।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বেশিরভাগ ভূমিকম্প হয়েছে রাতে। যেমন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সময়ে ভূমিকম্প হয়েছে ২৩টি। বাকি ১৬টি ভূমিকম্প হয়েছে দিনের বেলায় (ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা)। রাতে বেশিরভাগ মানুষ ঘুমিয়ে অথবা বাসায় থাকায় এমন সময়ে ভূমিকম্পে প্রাণহানির আশঙ্কা বেশি থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে এক থেকে তিন লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে এবং শহরের প্রায় ৩৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূয়মিকম্প গবেষক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলছেন, বড় ভূমিকম্প আসার আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, এটি তার আগাম বার্তা। সাধারণত একশ থেকে দেড়শ বছর পরপর একটি অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ও এর আশপাশের কাছাকাছি এলাকায় গত দেড়শ বছরে একটি বড় ও প্রায় পাঁচটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশের আশপাশে সবশেষ বড় ভূমিকম্প হয়েছিল প্রায় একশ বছর আগে। তাই আরেকটি বড় ভূমিকম্প কাছাকাছি সময়ে হতে পারে।
ভূমিকম্প আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন নরসিংদীবাসী : শুক্রবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী এবং সেখানেই সর্বোচ্চ পাঁচজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার পর জেলার বাসিন্দারা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন বলে জানিয়েছেন দেশ রূপান্তরের প্রতিনিধি সুমন বর্মণ।
আবার কখন ভূমিকম্প হয় সেই আতঙ্কে থাকা বাসিন্দারা বলছেন, সামনে যদি তার চেয়ে বেশি কম্পন হয়, তবে অবস্থা কী হবে বলা মুশকিল। এমন আশঙ্কায় মানুষের ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা।
জেলাবাসীর মনে এমনভাবে আতঙ্ক দেখা গেছে যে, গত শনিবার রাতে নরসিংদী শহরের বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন ভবন থেকে মানুষজন রাস্তায় নেমে পড়েছে। শহরের মানুষজন নরসিংদী সরকারি কলেজ মাঠ, জামিয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসা মাঠ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় মাঠসহ খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় গভীর রাত পর্যন্ত অবস্থান করতে দেখা গেছে।
আনিকা খানম নামে এক গৃহিণী বলেছেন, ‘ভূমিকম্পে খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল সব শেষ। আমি আমার শিশু সন্তানকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই পারছিলাম না। হাত-পা যেন কোনো কাজ করছিল না, মাথা ঝিমঝিম করছিল, সঙ্গে বমি পাচ্ছিল। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে খুবই ভয় পেয়েছিলাম। পুরো বিল্ডিং নড়ছিল। শেষ পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে নিরাপদ আশ্রয়ে দীর্ঘক্ষণ ছিলাম। এখন প্রতিমুহূর্ত কাটাচ্ছি আতঙ্কের মধ্য দিয়ে।’
দুপুরে গাবতলী জামিয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসায় গিয়ে কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। মুফাশ্বীর হোসেন মারুফ বলেন, ‘রাত ১১টায় ভূমিকম্প হবে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আতঙ্কে বিভিন্ন বাড়ি থেকে নারী-পুরুষ মাঠে এসে জড়ো হয়। তারা সবাই খুব ভয়ে ছিল। এভাবে ভূমিকম্পের গুজব ছড়ানো ঠিক হয়নি। প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
নরসিংদী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, শনিবার রাতে আতঙ্কিত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে গুজব ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে। সবার প্রতি অনুরোধ, গুজবে কেউ কান দেবেন না। পাশাপাশি ভূমিকম্পের ব্যাপারে যেহেতু আগাম কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া যাচ্ছে না, সেজন্য সচেতন থাকারও আহ্বান জানাই।