এল আর বাদল : বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন ঘটনায় কিংবা ধর্মীয় ব্যক্তিদের বক্তৃতা বিবৃতি ও আলোচনায় উঠে এসেছে ওয়াহাবি ও সালাফি প্রসঙ্গ। বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় সুফি, পীর বা বাউলদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর পরে এসব আলোচনা সামনে আসছে।
যদিও 'তৌহিদী জনতা' নাম নিয়ে এসব হামলার ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা নিয়ে সরকারের দিক থেকে কখনোই সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বক্তব্য আসেনি। ফলে এসব ঘটনার সাথে আদৌ 'ওয়াহাবি বা সালাফিদের' কোনো সম্পর্ক আদৌ আছে কি-না তাও নিশ্চিত নয়।
তবে গত এক বা দেড় দশকে দেশের অনেক মসজিদে জুমার নামাজের আগে বয়ানে কোনো কোনো ইমামকে সালাফিদের সমালোচনা, আবার কোনো ইমামকে ওয়াহাবিদের সমালোচনা করে বয়ান দিতে দেখা যাচ্ছে। --- সূত্র, বিবিসি বাংলা
মুসলিমদের মধ্যে ওয়াহাবি ও সালাফি কারা, বাংলাদেশে কীভাবে এবং কেন ক্রমান্বয়ে তারা আলোচনায় জায়গা করে নিলো, তারা কি একই ধারার না-কি পরস্পরবিরোধী- এমন অনেক প্রশ্ন অনেকের মধ্যেই আছে।
ইসলামি শিক্ষা ও বিশ্ব ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিতরা বলছেন, বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে তিনটি ধারা খুবই সক্রিয় এবং এই ধারাগুলো হলো ওয়াহাবি, সালাফি ও দেওবন্দ। আর ইসলাম ধর্মের মাজহাবের দিক থেকে বাংলাদেশে শক্তিশালী হলো হানাফি মাজহাবের অনুসারীরা।
তাদের মতে, এ তিন গোষ্ঠীর মধ্যে ইসলাম পালন নিয়ে মৌলিক পার্থক্য কম এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে এসব ঘরানার অনুসারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছেন।
আবার এর মধ্যে ওয়াহাবি ধারার বিস্তার ঘটাতে সৌদি সরকার কিংবা সৌদি বিভিন্ন ফাউন্ডেশন বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অর্থায়ন করেছে বলেও প্রচার আছে, যা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মেদ বিন সালমান ২০১৮ সালের মার্চে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন।
সালাফি ও ওয়াহাবি কারা
ইসলামি শিক্ষা ও বিশ্ব ধর্মের গবেষক ও শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অষ্টাদশ শতকে ওয়াহাবি ধারার সূচনা হয়েছে মক্কায় সৌদি আরবের ইসলামি পণ্ডিত আবদুল ওয়াহাব নজদির মাধ্যমে।
অন্যদিকে সালাফি ধারাটি এসেছে মিশরের দার্শনিক মোহাম্মদ আবদুর হাত ধরে যারা ইসলামের বিধি বিধান পালনের ক্ষেত্রে সাহাবা, তাবেঈন (যারা সাহাবাদের শিষ্য) এবং তাবে-তাবেঈন (যারা তাবেঈনদের শিষ্য) – এই তিন প্রজন্মকে ইসলামের বিশুদ্ধ ও আদর্শ হিসেবে মেনে চলার পক্ষপাতী।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কোরআন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান আশরাফি বলছেন, ওয়াহাবিরা সৌদি আরবের আবদুল ওয়াহাব নজদির অনুসারী।
তিনি কবর, পূজা ও মাজার প্রথার বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতেন। সৌদি আরবে আগের অনেক স্মৃতিচিহ্ন তিনি নষ্ট করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সালাফি হলো আহলে হাদিসের একটি ধরন। তারা নিজেদের সহিহ হাদিসের অনুসারী দাবি করে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাফী মো. মোস্তফা বলছেন, দুই তত্ত্বকে আলাদা করা কঠিন কারণ তাদের রুট বা উৎস একই। তার মতে, বরং এই অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে সুফিদের মাধ্যমে ফলে এখানে বিভক্তি হলো- সুফিকেন্দ্রিক আর অন্যদিকে সালাফি ও ওয়াহাবিজম।
সালাফি বলতে বোঝায় সালফে সালেহিন- সাহাবীদের প্রথম ৩ প্রজন্ম- তারা যেভাবে নিজেদের পিউরিফাই রেখেছিলো ওটাকেই তারা শরিয়ার মূল ভিত্তি ধরে। মুহাম্মদ আবদুহ মিশরের দার্শনিক। তার দার্শনিক অবস্থান থেকে এটি এসেছে। এখন পশ্চিমা বিশ্বেও সালাফি ও ওয়াহাবিবাদের প্রভাব চোখে পড়ছে," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
মি. মোস্তফা তার এক বইতে লিখেছেন, সালাফি চিন্তাধারা আধুনিক ধারাটি উনিশ শতকের মধ্য থেকে শেষভাগে বিকশিত হয়। ১৮৪৯ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ ধারার নেতৃত্ব দিয়েছেন মুহাম্মদ আবদুহ, জামাল উদ্দিন আল-আফগানি ও রাশিদা রিদা।
মূলত তারা মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুরু করেন যা পরবর্তীতে আধুনিক সালাফি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তাদের মূল্য লক্ষ্য ছিলো- কোরআন হাদিস ভিত্তিক ইসলামি পুনর্জাগরণ, অযাচিত লোকাচার ও অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্তি এবং মুসলিম সমাজে যুক্তি, বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ঘটানো।
সালাফিরা মনে করেন, তাদের ধারাই ইসলামের মূল স্রোত, তাই কোনো ব্যক্তিকে তারা এ ধারার প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন না। এটি কোনো আলাদা মতবাদ নয় এবং সালাফিরা কোরআন সুন্নাহর বাইরে কারও মত, ফতোয়া বা দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন।
এমন চিন্তার অনুসারীরা ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে হাদিস আর আরব অঞ্চলে সালাফি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। এমনকি ওয়াহাবি ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত আবদুল ওয়াহাব নজদি নিজেও সালাফি ঘরানার পণ্ডিত ছিলেন।
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, "ওহায়াবিরা কোনো প্রকার রহস্যময়তা ও ওলীদের বিশেষ ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন না। তাঁরা সমাধিসৌধ বৈধ মনে করেন না। তাই সৌদি আরবে সমাধিস্থলের কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি। ওহায়াবিরা একমাত্র নবীজীর সমাধিসৌধ ছাড়া আর কোনো স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন অনুমোদন করেন না"।
ওয়াহাবি মতবাদ বিস্তারে সৌদি আরব অর্থায়ন করে এমন প্রচার আছে।
দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৮ সালের মার্চে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "এই অর্থায়ন স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে শুরু হয়েছিলো। মুসলিম দেশগুলোতে সোভিয়েত প্রভাব ঠেকাতে মিত্রদেশগুলো সৌদি আরবকে তাদের সম্পদ মসজিদ মাদ্রাসায় বিনিয়োগ করতে বলেছিলো"।
"পরে সৌদি সরকারগুলো এই কার্যক্রমের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সব কিছু এখন আবার নিজেদের হাতে নিতে হবে। তবে এসব অর্থায়ন মূলত রাষ্ট্র নয়, বিভিন্ন ফাউন্ডেশন থেকে আসে," বলেছিলেন মি. সালমান।
বাংলাদেশে আলোচনায় কেন
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ অঞ্চলে বহুকাল আগে থেকেই ওয়াহাবিবাদ সক্রিয় এবং এ ভূখণ্ডে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন- ফরায়েজি আন্দোলন ও ওহাবি আন্দোলনের দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হাজী শরিয়ত উল্লাহ ও মীর নিসার আলী তীতুমীর ছিলেন ওয়াহাবি ঘরানার।
এর মধ্যে ফরায়েজি আন্দোলন ছিলো কৃষক আন্দোলন এবং এতে ওয়াহাবিরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলো অন্যায্য করের বিরুদ্ধে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত এটি নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নতুন এক ধারার সূচনা করেছিলো।
ফলে ওয়াহাবি ঘরানার উপস্থিতি এই অঞ্চলে অনেক পুরনো আর বাংলাদেশে সালাফি দর্শনে বিশ্বাসীদের অনেকেই ওয়াহাবি হিসেবেও পরিচিত। তবে এখন তাদের বড় পরিচিত হলো 'আহলে হাদিস' নামে, যার মধ্যে ওয়াহাবি ও সালাফি উভয়ই আছে।
বাংলাদেশে অবশ্য ওয়াহাবি-সালাফির চেয়ে হানাফি মাজহাবের অনুসারীই মুসলিমদের মধ্যে বেশি বলে ইসলামি পণ্ডিতরা মনে করেন।
এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান আশরাফি বলছেন, বাংলাদেশে সালাফি ও ওয়াহাবি নিয়ে যেসব কথাবার্তা শোনা যায় এমন ভাগাভাগি উপমহাদেশের বাইরে খুব একটা দেখা যায় না।
তবে সালাফি বা ওয়াহাবিদের মধ্যেও কট্টর আছে, লিবারেল আছে। তাদের কারোরই কোরআন, হাদিস বা আখেরাতের মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কোনো মতভেদ নেই,"বিবিসি বাংলাকে বলেছেন মি. আশরাফি।
তবে যেহেতু সালাফিরা ইসলামের সাহাবিদের প্রথম তিন প্রজন্মকেই একমাত্র মানতে চান আর ওয়াহাবিরা কবর ও মাজারের বিরুদ্ধে, সে কারণে এদেশে মাজার, বাউল বা সূফিদের স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধেই তারাই সক্রিয় বলে অনেকে মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাফী মো. মোস্তফা বলছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াহাবি সালাফি ধারণা বেশি আলোচনায় আসার কারণ হলো সৌদি আরবের সাথে নৈকট্য।
বাংলাদেশের বহু মানুষ সৌদি আরবে আছে কিংবা যাচ্ছে। অনেকেই ফিরে এসে ওয়াহাবি সালাফি ধারণা প্রচার করছেন। সৌদি আরব থেকে আসার পর তাদের ধারণার সাথে এখানকার বিদ্যমান অনেক কিছুর সাথেই ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে বিরোধ হচ্ছে। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে বিরোধ দেখা দিচ্ছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. মোস্তফা।
শাফী মো. মোস্তফা তার এক বইতে লিখেছেন, এদেশে সুফি ও পীররা ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং পীর সুফিদের অনেক মাজার ও দরগাও আছে দেশজুড়ে।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সুফীদের আবাসস্থল এবং দেশের মানুষের ওপর তাদের অপরিসীম প্রভাব আছে। আঠার শতক পর্যন্ত সুফি ইসলামই ছিলো এখানে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী। আবার বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ওয়াহাবি ও সালাফিরা ছিলেন," লিখেছেন তিনি।