ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, পিটিএসডি (PTSD), ঘুমের ব্যাধি, আসক্তি—সবকিছুতেই ভয়াবহ উল্লম্ফন। ইসরাইল এখন এক “মানসিক স্বাস্থ্য সুনামি”-র মুখোমুখি, যেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ জরুরি মানসিক সহায়তার অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির শীর্ষ সংবাদমাধ্যম ইয়েদিওথ আহরোনোথ।
শুক্রবার প্রকাশিত এক বিস্তৃত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তীব্র হারে বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, ট্রমার পুনরাবৃত্তি, ক্লান্তি, দুঃখ, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। এর সঙ্গে রয়েছে থেরাপিস্ট ও সহায়তা সেবার মারাত্মক সংকট—যা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে।
অভূতপূর্ব মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব
গত সপ্তাহে আটটি বড় মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারকে জরুরি সতর্কবার্তা দিয়ে জানায়—দেশে যে “মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব” চলছে, তা গভীরতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে অভূতপূর্ব।
তাদের ভাষায়:
“ইসরাইলি সমাজের মানসিক অবস্থার যে অবনতি, তা আগে কখনও দেখা যায়নি।”
দীর্ঘ যুদ্ধ, অস্থিরতা ও সহিংসতার কারণে বহু মানুষ ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, ক্লান্তি, আক্রমণাত্মক চিন্তা এবং মানসিক ভাঙনের মুখে পড়ছে। পরিবার ও কমিউনিটি ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ট্রমা বহু প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে।
চমকে দেওয়া পরিসংখ্যান
ইয়েদিওথ আহরোনোথের তথ্য অনুযায়ী—
• ২০২৪ সালে ডিপ্রেশন ও উদ্বেগের রোগ নির্ণয় ২০১৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।
• ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত প্রতি মাসে PTSD রোগীর সংখ্যা ৭০% হারে বেড়েছে, নতুন রোগী যোগ হয়েছে ২৩,৬০০ জন।
• ইসরাইলের প্রায় অর্ধেক মানুষ স্থায়ী দুঃখ বা শোকের লক্ষণ জানান।
• মানসিক স্বাস্থ্য হেল্পলাইনে কল বেড়েছে ছয়গুণ।
• মনোরোগ চিকিৎসার ওষুধ ব্যবহার দ্বিগুণ।
• যুদ্ধকালীন সময়ে ঘুমের ব্যাধি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯%।
ক্লালিট হেলথ সার্ভিস ও মায়ার্স-জেডিসি-ব্রুকডেল ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে—৭ অক্টোবরের হামলায় প্রভাবিতদের ৫০% এখনো মানসিকভাবে সংগ্রাম করছেন। এ ছাড়া দেশের প্রতি পাঁচজনের একজন গুরুতর কার্যক্ষমতার সমস্যায় ভুগছেন।
মিনিস্ট্রি অফ হেলথ জানিয়েছে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে থেরাপির সংখ্যা বেড়েছে ২৫%। শর্ট-টার্ম সাইকোথেরাপি কেস বেড়েছে ৪৭১%—২০২২ সালের ৩,৫০০ থেকে ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২০,০০০-এ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকৃত পরিস্থিতি সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়েও বহুগুণ খারাপ।
আসক্তির ঝুঁকি ভয়াবহ মাত্রায়
হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেরাভ রথ জানান, ক্লিনিকগুলোতে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, আসক্তি ও দাম্পত্য সংকটের রোগীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়ছে। তার মতে, এখন প্রতি চারজনের একজন আসক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে, যেখানে ২০১৮ সালে ছিল প্রতি দশজনের একজন। তিনি বলেন, “এই বৃদ্ধি সত্যিই ভীতিকর।”
সরকারের পদক্ষেপ ও সমালোচনা
ইসরাইলি সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ড. মারিনা কুপচিক সতর্ক করে বলেছেন— যদি এখনই মানসিক পুনর্বাসনে বড় বিনিয়োগ না করা হয়, তাহলে দুই-তিন বছরের মধ্যে দেশের কর্মক্ষমতা, পারিবারিক স্থিতি এবং সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে একটি জাতীয় উদ্ধার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে—
• মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা দ্বিগুণ
• বেতন বাড়ানো
• মনোরোগ ওয়ার্ড উন্নয়ন
• কমিউনিটি ও হোম-ভিত্তিক সেবা সম্প্রসারণ
এই পরিকল্পনার মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১.৭ বিলিয়ন শেকেল (৫১৭ মিলিয়ন ডলার)।
তবে বিশেষজ্ঞরা এটিকে যথেষ্ট মনে করছেন না।
ইজরায়েল সাইকোলজিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ইয়োরাম শ্লিয়ার জানান—মাত্র তিন মাসের প্রশিক্ষণে “মেন্টাল হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট” নিয়োগের ওপর নির্ভরতা ভয়াবহ ভুল, যেখানে একজন পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর প্রশিক্ষণ লাগে আট বছর।
ড. ইলানা লাচ সিস্টেমকে “অতিমাত্রায় চাপগ্রস্ত” বলে মন্তব্য করে বলেন—“রক্তক্ষরণ হওয়া ক্ষতে শুধু ব্যান্ডেজ লাগিয়ে হবে না। মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।”
সূত্র: জনকণ্ঠ