সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবরি মসজিদ নিয়ে পোস্ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত এক মুসলিম ব্যক্তির বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারি মামলা খারিজের আবেদন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) নাকচ করে দিয়েছে। ওই ব্যক্তি তার পোস্টে লিখেছিলেন, ‘তুরস্কের সুফিয়া মসজিদের মতো বাবরি মসজিদ একদিন আবার পুনর্নির্মিত হবে।
বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির বেঞ্চ মামলাটি শুনানির আবেদন প্রত্যাহারের পর তা খারিজ করে দেন। আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী তালহা আবদুর রহমান আদালতে বলেন, পোস্টটিতে কোনো অশালীন বা উসকানিমূলক বক্তব্য ছিল না। বরং অন্য এক ব্যক্তি বিতর্কিত মন্তব্য করলেও তদন্তের আওতায়ই আসেননি।
তবে আদালত এতে সন্তুষ্ট হননি। বিচারপতি সূর্যকান্ত বলেন, ‘আমরা পোস্টটি দেখেছি। আমাদের কাছ থেকে কোনো মন্তব্য আহ্বান করবেন না’। এভাবে তিনি আইনজীবীকে সতর্ক করেন। আদালত জানায়, মামলায় উত্থাপিত সব যুক্তি এখন বিচারকালীন আদালত নিজস্বভাবে বিবেচনা করবে।
মামলাটি ২০২০ সালের ৬ আগস্টের ঘটনা, ওইদিন মনসুরি নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি ফেসবুকে ‘অশোভন ও উসকানিমূলক’ বার্তা পোস্ট করেছেন। অভিযোগে বলা হয়, পোস্টটিতে সামরিন বানু নামে এক নারী হিন্দু দেবদেবীদের সম্পর্কে আপত্তিকর ও উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন।
ভারতীয় দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারায় এফআইআরটি দায়ের করা হয়। এরপর লখীমপুর খেরির জেলা প্রশাসক জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএ), ১৯৮০ অনুযায়ী মনসুরির বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেন। তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই আটকাদেশ বাতিল করে দেন।
চলতি বছরের শুরুতে ট্রায়াল কোর্ট পুলিশের দাখিলকরা চার্জশিট গ্রহণ করে মামলার কার্যক্রম শুরু করে। এরপর মনসুরি আবার হাইকোর্টে যান। তিনি দাবি করেন, তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছিল, তিনি নিজে কোনো পোস্ট দেননি, কোনো উসকানির উদ্দেশ্যও তার ছিল না। তার মতে, রিতেশ যাদব নামে এক ব্যক্তি ‘সামরিন বানু’ নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে আপত্তিকর মন্তব্যটি করেছিলেন।
এভাবে আদালতে এখন মামলাটি চলমান। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, মূল বিচারিক আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।
গত সেপ্টেম্বরে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম বাতিল করতে অস্বীকার করে, তবে নির্দেশ দিয়েছিল যেন, মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা হয়। এ সিদ্ধান্তে অস্তুষ্ট হয়ে মনসুরি পরে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তার আবেদনও খারিজ করে দেয়।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙা ঘটনাটি ভারতের ইতিহাসে মুসলিমবিরোধী সহিংসতার একটি বড় অধ্যায় হিসেবে স্মরণ করা হয়। সেদিন আরএসএস, ভিএইচপি ও বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার করসেবক (হিন্দুত্ববাদী স্বেচ্ছাসেবক) প্রকাশ্য দিবালোকে অযোধ্যার ১৬শ’ শতকের এ মসজিদটি ভেঙে ফেলে।
বাবরি মসজিদটি ১৫২৮ সালে মোগল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকী নির্মাণ করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর দাবি ছিল, এ স্থানটিই নাকি কথিত ভগবান রামের জন্মস্থান, যেখানে আগে একটি মন্দির ছিল। আদালতে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, মসজিদের কোনো ক্ষতি করা হবে না, কিন্তু সেই আশ্বাস ভঙ্গ করে মসজিদটি ধ্বংস করা হয়।
বাবর আমলে নির্মিত এ ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংসের পর সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, যা কয়েক মাস ধরে চলে। এতে ২শ’রও বেশি মানুষ নিহত হন, যা স্বাধীনতার পর ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে ধরা হয়।
‘বাবরি তো কেবল শুরু, এবার কাশি আর মথুরার পালা’ এমন উসকানিমূলক সেøাগান শোনা যায় ঘটনার সময় ও পরে, যা দেশে ইসলামবিরোধী উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে তোলে।
২০১৯ সালের রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানায়, বাবরি মসজিদ ভাঙা ছিল ‘অবৈধ কাজ’ এবং ‘আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন’। আদালত আরো উল্লেখ করে, ১৯৪৯ সালে মসজিদে মূর্তি স্থাপন করে যে অপবিত্রতা ঘটানো হয়েছিল, সেটিও বেআইনি। তবে রায়ে বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমিটি হিন্দু পক্ষকে দিয়ে রামমন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়।
সূত্র : মাকতূব মিডিয়া।