দেশের অর্থনীতির পরিধি যেভাবে বাড়ছে, তার বিপরীতে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার। গত কয়েক বছরে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩৩ লাখ থেকে ১৬ লাখে নেমেছে। এর মধ্যে সক্রিয় বিনিয়োগকারী ১২ লাখের কম। এ ছাড়া কর ব্যবস্থাসহ সামগ্রিকভাবে বাজারের কাঠামো এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থার মধ্যে ১১৭টি ব্রোকারেজ হাউস বন্ধ হয়ে গেছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে শুধু বিনিয়োগকারীই নয়, ট্রেকহোল্ডাররাও নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকার পরিবর্তনের পর বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর যে ক্ষীণ ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, তা খুব দ্রুতই মিলিয়ে গেছে। আস্থাহীনতা, দীর্ঘদিনের নীতিগত ভুল, দুর্বল তদারকি আর লেনদেনের খরা মিলিয়ে বাজারের গতি যেন থমকে গেছে।
জানা গেছে, বছরের শুরু থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে প্রায় ৩৫০ পয়েন্ট। গড় লেনদেন কমে গেছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে। এই সময়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন ৬৬ হাজার ৭৭৭ জন বিও হিসাবধারী। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৪৭ হাজার সরাসরি হিসাব বন্ধ করে বাজার ছেড়েছেন। শেয়ারশূন্য হিসাবের সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় ২০ হাজার।
বিও হিসাবধারীদের লেনদেন সুবিধা দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে নিবন্ধিত ট্রেক সনদ নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যভুক্ত হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। এখন পর্যন্ত স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেকহোল্ডার হিসেবে ব্যবসা শুরু করেছে ৩০৭টি ব্রোকারেজ হাউস। এর মধ্যে গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ৫টি ব্রোকারেজ হাউসের কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। সচল থাকা বাকি ৩০২টি ব্রোকারেজ হাউসের মূল অফিস ও শাখা অফিসের সংখ্যা প্রায় ১৫০০টি। এর মধ্যে অনেকেই বাজারে লেনদেন কম থাকায় লোকসান এড়াতে শাখা অফিস বন্ধ রাখার পাশাপাশি মূল অফিসের কার্যক্রমও কৌশলে বন্ধ রাখছে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মূল অফিস ও শাখা অফিসের অধিকাংশই রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম অঞ্চলে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত সচল থাকা ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মূল অফিস ও শাখা অফিস বন্ধ হয়েছে ১১৭টি। বাজারে লেনদেন কম হওয়া, সনদ নবায়ন না হওয়া এবং অফিস সংস্কারের কথা জানিয়ে বন্ধ রাখা হচ্ছে এসব হাউস। এর মধ্যে বিকল্প লেনদেন অফিস না থাকায় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের হিসাবধারী এখন শেয়ার লেনদেনও করতে পারছে না।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬৬ হাজার ৭৭৭টি বিও হিসাবধারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে সরাসরি বিও হিসাব বন্ধ হওয়ায় বাজার ছেড়েছেন ৪৭ হাজার ৩১৭ জন বিনিয়োগকারী। এ ছাড়া ১৯ হাজার ৪৬০ জন বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব শেয়ার শূন্য হয়েছে আলোচিত সময়ে।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে লাভজনক অবস্থানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন (আইসিবি) এখন লোকসানে ডুবেছে। পরিস্থিতি এমন যে প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া, অতি মূল্যের শেয়ারে বিনিয়োগ এবং শেয়ারের মূল্যে ধস প্রতিষ্ঠানটিকে এ অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে আইসিবি। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের লোকসান ১৫১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে আইসিবির আনরিয়ালাইজড লস বা ফান্ড ইরোশন ৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে বিএসইসি। শেয়ার শূন্য ঘোষণার পর এসব শেয়ার বিও হিসাব থেকে মুছে দেওয়া হয়।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম জানান, ‘অধিকাংশ ব্রোকারেজ হাউসই এখন টিকে থাকার মতো মুনাফা করতে পারছে না। ভালো শেয়ার না থাকায় বিনিয়োগকারী ভালো প্রফিট করতে পারছে না, আর বাজারে লেনদেন কমায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোরও একই অবস্থা।
তিনি বলেন, ‘বাজারে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। আমরা বিগত সরকারের আমলে যে অস্বচ্ছতা দেখতে পেয়েছি, এখনও সেই অবস্থার পুরোপুরি উত্তরণ হয়নি। তা ছাড়া ভালো শেয়ার বাজারে না থাকায় বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাজার ছেড়ে দিচ্ছেন। তাদের ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শক্তিশালী পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের জোরালো ভূমিকা থাকতে হবে।’
জানা গেছে, বর্তমানে দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছেও শেয়ারবাজারের গুরুত্ব কমেছে। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও অত্যন্ত নেতিবাচক। শেয়ারবাজার সব দিক থেকে সংকটে। নতুন কোনো আইপিও আসছে না। বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়ছে না। কিন্তু এ ব্যাপারে কারও কোনো উদ্যোগ নেই।
জানা গেছে, দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া শ্রীলংকা কিংবা অর্থনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত পাকিস্তানের পুঁজিবাজার গত বছর বেশ ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। এশিয়ার উদীয়মান পুঁজিবাজারগুলোয় সবচেয়ে বেশি রিটার্ন এসেছে এ দুটি দেশের পুঁজিবাজারে। এ সময় ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের পুঁজিবাজারে রিটার্ন ছিল কিছুটা নেতিবাচক। অন্য দেশগুলোর পুঁজিবাজার গত বছর ইতিবাচক ধারায় ছিল। শুধু সূচকের রিটার্ন নয়, বাজার মূলধন, লেনদেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণসহ অনেক সূচকেই এগিয়ে ছিল এসব দেশের পুঁজিবাজার। তবে বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অবস্থান সবার নিচে।
সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়