মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে ভাঙারি স্বর্ণ পাচার হয়ে দেশে আসছে। পরে এ স্বর্ণ ঢাকার তাঁতীবাজারে স্বর্ণের বারে রূপান্তর করে পাচার হচ্ছে ভারতে। হুন্ডির মাধ্যমে হওয়া লেনদেনের অর্থ জমা হচ্ছে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে। এ প্রক্রিয়ায় স্বর্ণ চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। চোরাচালানের রুট স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রভাবশালীরা। বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সীমান্তকেন্দ্রিক অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রসার রোধ করা যাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিআইডির তথ্য বলছে, নামসর্বস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খুলে দীর্ঘদিন ধরে বড় অংকের টাকা লেনদেন করছে ঢাকার তাঁতীবাজারকেন্দ্রিক কয়েকটি চক্র। এর মধ্যে আইনক্স ফ্যাশন, ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ, জামান এন্টারপ্রাইজ ও নোহা এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত লেনদেনের রেকর্ড রয়েছে। সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে আন্তর্জতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের অন্যতম একজন হিসেবে কাজ করেন মনীন্দ্র নাথ বিশ্বাস। তিনি তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ী। তিনি বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাঙারি স্বর্ণ সংগ্রহ করেন। পরে তা তাঁতীবাজারে নিয়ে গলানো হয়। এভাবে ভাঙারি স্বর্ণ পাকা স্বর্ণের বারে রূপান্তর হয়। পরে এ স্বর্ণ সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হয়। বিনিময়ে কখনো হুন্ডির মাধ্যমে টাকা, কখনো আবার অস্ত্র ও মাদক দেশে প্রবেশ করছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মনীন্দ্র নাথ বিশ্বাস বিভিন্ন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খুলে ৬০৮ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। এ টাকা হস্তান্তর ও হুন্ডির মাধ্যমে রূপান্তর করে ভোগ-বিলাস, অর্থ পাচার এবং বেনামে সম্পত্তির মালিকও হয়েছেন। এগুলো স্পষ্টতই মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
শুধু মনীন্দ্র নাথ বিশ্বাসই নন, তার মতো অন্তত দুই ডজন কারবারি দেশ থেকে অবৈধ পথে ভারতে স্বর্ণ পাচার করছেন বলে জানা গেছে। এমনই আরেক ব্যবসায়ী শ্যাম ঘোষ। সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, শ্যাম ঘোষ একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ঢাকার সূত্রাপুরে তার বাবার হোটেলে কাজ করতেন। পরে বিভিন্ন স্বর্ণের দোকানে চাকরির মাধ্যমে তিনি অবৈধভাবে পাওয়া স্বর্ণ কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কেনাবেচা শুরু করেন। অবৈধ এ কারবার থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তার আয়ের উৎস গোপন রেখেছেন। সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে স্বর্ণ চোরাকারবারের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে শ্যাম ঘোষ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ও দোকান কিনেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যমুনা ফিউচার পার্কের ষষ্ঠ তলার সি ব্লকে তিনটি দোকান এবং ইন্ডিয়ান ডোমেস্টিক স্পাইস নামের রেস্টুরেন্ট। এছাড়া ওয়াইজঘাটে বাবুলী স্টার সিটি ভবনের পঞ্চম তলায় একটি ফ্ল্যাট এবং স্বামীবাগের স্বর্ণচাঁপা ভবনের ষষ্ঠ তলায় ভাইয়ের সঙ্গে যৌথ মালিকানাধীন ফ্ল্যাট রয়েছে তার। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের লেভেল ৫-এর বি ব্লকে নন্দন জুয়েলার্স নামে তার স্বর্ণের দোকানও রয়েছে।
তাঁতীবাজারের আরেকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী তাপস মালাকার। তিনিও নিয়মিত দেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ থেকে আয়ের অর্থ সাদা করার জন্য ব্যবহার করেন নামসর্বস্ব কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। বসুন্ধরা সিটির চতুর্থ তলায় ছোট্ট একটি দোকান জয়া ফ্যাশন। ভারতীয় কাপড়ের এ দোকানে তেমন বিকিকিনি না হলেও এর ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত বড় ধরনের লেনদেন হয়। সেই লেনদেনের উৎস খুঁজতে গিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের (বিএফআইইউ) নজরদারিতে পড়েন তাপস মালাকার। পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। সেই অনুসন্ধানে উঠে আসে তাপস মালাকার ও তার স্ত্রী মন্টি মালাকারের স্বর্ণ চোরাচালানের বিস্তারিত। এ মালাকার দম্পতি নিয়মিত সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এর আগে তারা র্যাবের হাতে অবৈধ স্বর্ণসহ গ্রেফতার হয়ে কারাগারেও গিয়েছেন। মালাকার দম্পতির ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা সিটিতে দুটি ও যমুনা ফিউচার পার্কে একটি দোকান রয়েছে। তবে এত সব সম্পদ থাকলেও তাপস মালাকারের নেই কোনো কর ফাইল। স্ত্রী মন্টি মালাকারের কর ফাইল থাকলেও সেটি তিন বছর হালনাগাদ হয়নি।
জয়া ফ্যাশনের ব্যাংক হিসাবে বড় লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তাপস মালাকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাঁতীবাজারে আমার স্বর্ণের ব্যবসা আছে। কিন্তু ওই ব্যবসার বিপরীতে কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। সেখানকার টাকা জয়া ফ্যাশনের ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় প্রতিবেশী ব্যবসায়ীদের লেনদেনেও জয়া ফ্যাশনের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার হয়েছে।’
স্বর্ণ চোরাচালানের মামলা তদন্ত তত্ত্বাবধানে রয়েছেন সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জয়া ফ্যাশনের অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। পাশাপাশি আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী শ্যাম ঘোষের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ধরনের স্বর্ণ চোরাচালানে তাঁতীবাজারের আরো বেশ কয়েকজন স্বর্ণ কারবারির তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এদিকে ভারতের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাধ্যমে ভারতে স্বর্ণ চোরাচালান বেশি হয়। ভারতে বছরে আট লাখ কেজি স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। দেশটিতে বছরে ৮০-৯০ হাজার কেজি স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে প্রবেশ করে। ভারতে স্বর্ণ আমদানির শুল্ককর বেশি। ফলে চোরাই পথে স্বর্ণ বাণিজ্য লাভজনক। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে গত পাঁচ বছরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রায় ৭২৫ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। গত পাঁচ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৮৪০ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে। ঢাকা কাস্টম হাউজ শুধু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গত দুই বছরে ৪৩৬ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। গত দুই বছরে এ তিন সংস্থা মিলে ১ হাজার ১৬৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। তবে জব্দ করা স্বর্ণের চেয়ে পাচার হওয়া স্বর্ণের পরিমাণ বেশি বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এসব জুয়েলারি ব্যবসায়ীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাদের স্বর্ণ চোরাচালান-সংশ্লিষ্টতা বা গ্রেফতারের বিষয়েও আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আমরা মূলত জুয়েলারির রিটেইল পর্যায়ের কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করি।’
স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মতে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েনে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন অস্থির। এতে হু হু করে বাড়ছে স্বর্ণের দাম। বর্তমানে দেশে স্বর্ণের ভরি ২ লাখ টাকা ছুঁইছুঁই। দাম বাড়ায় কমছে স্বর্ণের ব্যবহার। অর্থনীতির নিয়মে দাম বাড়লে চাহিদা কমার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে ঘটছে বিপরীত ঘটনা। দাম বাড়ায় ব্যবহার কমলেও চোরাচালানকারীদের কাছে স্বর্ণের চাহিদা বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে স্বর্ণ পাচারকালে বেশ কয়েকটি চালানসহ গ্রেফতার করা হয়েছে কয়েকজনকে।
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত পথে পাচারের সময় ২০২০ সালে ৪১ কোজি ৭৭২ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ৫০ কেজি ৪৩৩ গ্রাম স্বর্ণ, ২০২২ সালে ১৯৪ কেজি ৯৯৩ গ্রাম, ২০২৩ সালে ২৬০ কেজি ৫৬৭ গ্রাম ও ২০২৪ সালে ১৩১ কেজি ৪২৪ গ্রাম স্বর্ণ পাচারের সময় সীমান্তে জব্দ করা হয়েছে। আর চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সীমান্ত এলাকা থেকে পাচারের সময় ৪৪ কোজি ৮৯১ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে।
সীমান্তে চোরাচালান রোধে কঠোর অবস্থানের কথা জানান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল এসএম শফিকুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সীমান্তে স্বর্ণসহ সব ধরনের চোরাচালান রোধে বিজিবি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে চোরাচালানপ্রবণ সীমান্তগুলোয় অতিরিক্ত টহল পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও অব্যাহত রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। গত এক বছরে আমরা ১২২.৬৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছি যার মূল্য ১৯৫.৩২ কোটি টাকা, যা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে এবং স্বর্ণ চোরাচালান-সংক্রান্ত বিষয়ে ৮০ জন চোরাকারবারিকে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।’ সূত্র: বণিক বার্তা