এস. এম সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাতবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তনের ছোবল এখন শুধু গাছপালা বা প্রাণিজগতে সীমাবদ্ধ নয় এর চুপিসারে সবচেয়ে ভয়ানক আঘাতটা এসে পড়েছে নারীদের শরীরে। মোংলার নারীরা প্রতিদিন লড়ছেন এক অনাহুত শত্রু লবণাক্ত পানির বিরুদ্ধে। বিশুদ্ধ পানি সেখানে এখন স্বপ্নের মতো দুর্লভ। রান্না, গোসল, এমনকি দৈনন্দিন পরিচর্যাতেও ব্যবহার করতে হচ্ছে নোনা পানি, যার প্রভাবে বাড়ছে চর্মরোগ, ইউরিন ইনফেকশন, প্রজনন জটিলতা, এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত। পরিবেশগত সংকট থেকে এটা রূপ নিয়েছে এক নীরব গভীর স্বাস্থ্যবিপর্যয়ে।
উপকূলের শহর মোংলায় একসময় যেখানে পানি ছিল জীবন, আজ তা হয়ে উঠেছে নোনা বিষ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় আর নদীভাঙনের কারণে পানির উৎসগুলোতে বাড়ছে লবণাক্ততা।
এই পানিই ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন নারীরা।গোসল, রান্না এমনকি দৈনন্দিন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজেও। ফলে শরীরে দেখা দিচ্ছে চুলকানি, ঘা, মূত্রনালী সংক্রমণ, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, এমনকি জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ। এত কিছু সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতায় নারীরা মুখ বুঁজে সহ্য করছেন এই নীরব বিপর্যয়।মোংলার চাঁদপাই ইউনিয়নের দক্ষিণ কাইনমারী এলাকার বাসিন্দা শীলা সরদার বলেন, “পশুর নদী পাড়ের লবণ পানি একমাত্র আমাদের ভরসা। গোসল, রান্না সহ ব্যাবহারের জন্য লবন পানি আমাদের একমাত্র সঙ্গী। লবণ জলে আমাদের জীবন জ্বলে। খাওয়ার পানিও ঠিকমতো পাই না, ডাক্তার তো দূরের কথা।”
স্থানীয় নারী উন্নয়নকর্মী কমলা সরকার বলেন, “ আমরা সুন্দরবন লাগোয়া উপকূলীয় মানুষ। চারিদিকে থৈ থৈ পানি কিন্তু সুপেও পানির প্রচুর সংকট। পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার ফলে নারীদের, গর্ভবতী মায়েদের, শিশুদের ও বয়স্কদের দুর্ভোগ সীমাহীন।”
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)'র কেন্দ্রীয় নেতা পরিবেশবীদ মোঃ নূর আলম শেখ জানান, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে নারীর শরীরে। লবণাক্ত পানি শুধু অসুস্থতা আনছে না, কেড়ে নিচ্ছে নারীদের স্বাস্থ্য ও সম্মান। এই সংকট শুধু ব্যক্তি বা পারিবারিক নয় এটা বৈশ্বিক দায়। আমরা উন্নত বিশ্বের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছি, এবং সরকারের কাছে উপকূলীয় বাজেটে নারীদের জন্য আলাদা বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।”
মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ শাহীন বলেন, “গত কয়েক বছরে উপকূলীয় নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক বেড়েছে। অনিয়মিত ঋতুস্রাব, জরায়ু সংক্রমণ, এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগও এখন নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ লবণাক্ত পানি।”
স্থানীয়দের দাবি মোংলার নারীরা কেবল লবণাক্ত পানির সঙ্গে বসবাস করছেন না তারা লড়ছেন প্রতিদিন, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে। এই লড়াইয়ে কেবল সহানুভূতি নয় প্রয়োজন নিরাপদ পানির টেকসই ব্যবস্থা, নারী স্বাস্থ্যসেবা এবং জলবায়ু অভিযোজনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।