রুকুনুজ্জামান, পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ দিনাজপুরের পার্বতীপুর মধ্যপাড়া রেঞ্জ বন বিভাগের কুশদহ বনবিটের ১ হাজার ১০০ একর জমি দখলে নিয়েছেন উপকারভোগীরা। রাতের আঁধারে গাছ কেটে নিয়ে সরকারি বনভূমিকে কৃষিজমিতে রূপান্তর করে চাষাবাদ শুরু করেছেন অন্তত ৭০০ উপকারভোগী। আবার বন বিভাগের জমি দখলের পর বিক্রিও করে দিয়েছেন শতাধিক উপকারভোগী। দখলকারীরা প্রায় ৩০০ একর বনভূমিতে নির্মাণ করছেন দ্বিতল বাড়ী, রিসোর্ট-কটেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি। এ বিটের কুষ্টিয়াপাড়া, চাঁপাইপাড়া, হঠাৎপাড়া, অফিসপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, জায়গিরপাড়া ও স্বষ্ঠীপাড়ায় এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। উপকারভোগীদের দাপটে অসহায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কোনোভাবেই এসব উপকারভোগীদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না বন বিভাগের জমি।
পার্বতীপুর মধ্যপাড়া রেঞ্জ সূত্র জানায়, পার্বতীপুর মধ্যপাড়া রেঞ্জ বন বিভাগের সরকারি অর্থায়নে বন বিভাগ সৃজিত সরকারি বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার জন্য ২০০০-২০০১ অর্থবছরসহ বিভিন্ন সময়ে ৫৫০ উপকারভোগীর সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি করা হয়। ২০১০-২০১১ অর্থবছর এসব উপকারভোগী তাদের নিলাম মূল্যে বিক্রির ৪৫% টাকা বুঝে পায়, বাকি ৫৫% টাকা পায় সরকার। এরপর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সেখানে নতুন করে লাগানো হয় গাছ। সেই গাছ অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেয় উপকারভোগীরা। এভাবেই মধ্যপাড়া বন বিভাগের জমি দখলের পর বিক্রিও করে দিচ্ছেন উপকারভোগীরা। রাতের আঁধারে গাছ কেটে নিয়ে ধীরে ধীরে তা কৃষিজমিতে রূপান্তর করে চাষাবাদ শুরু করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুশদহ বিটের অফিসপাড়ার ছাইদুল পাগলা অন্তত ১০ একর জমি দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছেন। এছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর কাছে তার দখলে থাকা প্রায় ১০০ একর জমি বিক্রি করে দেন। অফিসপাড়ায় ১০ একর জমিতে মাল্টা বাগান, ১০ একর জমিতে আম বাগান ও ১০ একর বনভূমি কৃষিজমিতে রূপান্তর করে চাষাবাদ করছেন উপকারভোগী মোক্তার হোসেন হাজি। একই এলাকার হাকিম মাস্টার ১৫ একর জমিতে আম বাগান ও ১৫ একর জমিতে চাষাবাদ করছেন। হাদিসপাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য রাহেনুল ইসলাম ৩০ একর জমিতে চাষাবাদ করছেন। তার দখলে থাকা ১৫ একর বনভূমি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। হঠাৎপাড়া গ্রামের শিবপুর ইসলামিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার নুর ইসলাম ১৫ একর জমিতে চাষাবাদ করছেন। হাদিসপাড়ার ইব্রাহিম আলীর নেতৃত্বে গত ৭ আগস্ট রাতের আঁধারে ৮ একর জমি দখল হয়েছে। বর্তমানে সেই সরকারি জমিতে সবজি চাষ করা হচ্ছে।
সাংবাদিদের কাছে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য রাহেনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মাত্র ৫০ শতাংশ জমি চাষাবাদ করি। তাছাড়া আমি কোনো জমি বিক্রি করিনি।’ আরেক অভিযুক্ত শিবপুর ইসলামিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার নুর ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো জমি চাষাবাদ করি না। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তোলা হয়েছে।’
পার্বতীপুর মধ্যপাড়া রেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, মধ্যপাড়া রেঞ্জের কুশদহ বিটের ১ হাজার ৫২৫ একর জমির মধ্যে ১ হাজার ১০০ একর উপকারভোগীর দখলে চলে গেছে। অবশিষ্ট আছে মাত্র ৪২৫ একর জমি।
সাংবাদিদের কাছে পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া রেঞ্জের কর্মকর্তা আল আমিন হক জানান, মধ্যপাড়া রেঞ্জের কুশদহ বিটে নিরাপত্তার কারণে কোনো বিট কর্মকর্তা কর্মস্থলে থাকতে পারছেন না। বন বিভাগের বাগানে সাধারণত টেন্ডার থাকে না। শুধু উপকারভোগীরা ‘অ্যাগ্রো ফরেস্ট’ নিয়মে ১৮ ফুট পরপর তিন সারি গাছ রেখে মধ্যখানে চাষাবাদ করতে পারেন। এরজন্য কোনো খাজনা দিতে হয় না। ১০ বছর পর নিলাম মূল্যে গাছ বিক্রির ৪৫% টাকা পাবে তারা, আর সরকার পাবে ৫৫% টাকা। কিন্তু উপকারভোগীরা তা না করে বনভূমিকে ফসলি জমিতে রূপান্তর করছে, যেটা সম্পূর্ণ বেআইনি।
তিনি আরও জানান, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার বন বিভাগ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মধ্যপাড়া রেঞ্জ। এ রেঞ্জের অধীনে রয়েছে মধ্যপাড়া সদর, নবাবগঞ্জ কুশদহ বিট, আফতাবগঞ্জ বিট, ভবানীপুর বিট ও পার্বতীপুর উপজেলা নার্সারি। মধ্যপাড়া রেঞ্জে মোট ৭ হাজার ১৫০ একর বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে এখানে বনভূমি আছে মাত্র ২ হাজার ১৫০ একর। আর বাকি ৫ হাজার একর বনভূমি বেদখলে চলে গেছে বলে তিনি জানান।
বন বিভাগের জমি দখলের উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আল আমিন হক বলেন, ‘উপকারভোগীদের সঙ্গে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার চুক্তি ছিল। এখন তারাই বন ধ্বংস করে বনভূমি কৃষিজমিতে রূপান্তর করে চাষাবাদ করছেন। দখল ছেড়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি ১৪ জনকে নোটিস দেওয়ার পরও তারা দখল ছাড়েনি। কুশদহ বিটের বনভূমি দখলমুক্ত করতে ৭২ মামলাও দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দখল উচ্ছেদে ৩১৪ বার নোটিস করা হয়েছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত ১০০ একর জায়গা দখলমুক্ত করা হয়েছে।’
সাংবাদিদের কাছে নবাবগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল মতিন বলেন, মামলা ও অভিযোগ যা কিছু হয়েছে, তা তদন্তাধীন আছে। তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।