ড. শোয়েব সাঈদ: টকশো আর কলামে অনেকবার উল্লেখ করেছিÑ কোভিড ভ্যাকসিনের চাহিদা বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ, ডাবল ডোজের হিসেবে প্রায় ১২০০ কোটির মতো। বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদকের ১০০ শতাংশ সক্ষমতায় বার্ষিক উৎপাদন দেড়শ কোটি ডোজ। ফলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন উৎপাদন করে কোভিড ভ্যাকসিনের চাহিদার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে উৎপাদকরা। খুব সাধারণ যেকোনো রোগে ওষুধের পরিমাণ বৈশ্বিক জনসংখ্যার কিছু অংশ মাত্র এবং সেটি বিশ্বের ধনী-গরিব অনেক দেশেই তৈরি হয়। সেই হিসেবে কোভিড ভ্যাকসিনের চাহিদা নজিরবিহীন মাত্রায় অথচ সক্ষমতা মাত্র কয়েকটি দেশের হাতে এবং এর উৎপাদন কর্মযজ্ঞ মূলত জটিল এক আয়োজন।
ওষুধের চেয়ে অনেক স্পর্শকাতর এবং কারিগরিভাবে চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে ভ্যাকসিন উৎপাদন প্রক্রিয়া। বিশে^র অন্যতম ভ্যাকসিন উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও হুট করে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। এই বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলে এসেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে ভ্যাকসিন গ্লোবালাইজেশন বনাম ন্যাশনালিজমের তীব্র টানাপোড়েনে আর ভ্যাকসিন রাজনীতি আর উৎপাদন সক্ষমতার জটিল সাংঘর্ষিক অবস্থায় নিরাপত্তার কারণে সেরাম সিইও আদর পুনাওয়ালাকে ভারত ছেড়ে ব্রিটেনে চলে যেতে হয়েছে। টাইমস’এর কাছে সাক্ষাৎকারে আদর পুনাওয়ালা বলেন, ভ্যাকসিন তৈরি করার প্রক্রিয়া খুব জটিল। ইচ্ছা করলেই তার উৎপাদন বাড়ানো যায় না। ভারতের জনসংখ্যা বিপুল। সবার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক ডোজ তৈরি করা সহজ কাজ নয়। ভারতে বহু প্রভাবশালী মানুষ তাকে ফোন করে দ্রুত ভ্যাকসিন পাঠাতে বলেছিলেন। এই চাপে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এবার আসি বাংলাদেশে। এই পরিস্থিতিতে সেরামের ওয়াদাকৃত ভ্যাকসিনের বাংলাদেশে আসার আশা প্রায় ছেড়েই দিতে হচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রীকে দেখলাম সেটিই বলছেন। সেরাম সংকট অর্থাৎ বাংলাদেশে কোভিশিল্ড আসা বন্ধ হবার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশে স্পুটনিক ভ্যাকসিনসহ চাইনিজ ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে কর্তৃপক্ষ আর কিছু ফার্মা কোম্পানি বেশ আশার বাণী শোনাচ্ছেন আমাদের। ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে আমি ইন্সেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেডের একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা দেখেছি ইন্টারনেটে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল অণুজীব বিদ্যায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বলা যায়, কোভিড ভ্যাকসিন টোল ম্যানুফেকচারিংয়ের জন্য বাংলাদেশের ফার্মা কোম্পানিগুলো কতোটুকু প্রস্তুত কিংবা কোভিডের নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিনের আলোকে তাদের প্রোডাকশন লাইন কতোটুকু সহায়ক অথবা প্রয়োজনীয় লাইন এডজাস্টমেন্টের সম্ভাব্যতা এবং সেটি করতে প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে বিস্তারিত ধারণা থাকাটা অত্যাবশ্যক। প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে ভ্যাকসিন উৎপাদনে উদ্ভাবকদের সমমানের সেট আপটা জরুরি।
আমরা করতে পারব এ ধরনের বায়বীয় আলোচনার চাইতে করতে পারার কোন স্তরে আছেন এবং এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে ঝুকিগুলোর সম্ভাব্য মাত্রা নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যাকসিনের উৎপাদনের অভিজ্ঞতা আছে বলেই কোভিড ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারবো কেন্দ্রিক হাইপোথেটিক্যাল মিডিয়া ভিত্তিক আলোচনার চাইতে নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনটি উৎপাদনে বাস্তবে সংযুক্ত থাকাটা জরুরি। বিদেশি ভ্যাকসিন কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা, সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রোডাকশন লাইন, মাননিয়ন্ত্রণ, সাপ্লাই চেইনের মতো বিষয়গুলোতে যথেষ্ট সময় দরকার। তিনমাস বা ৬ মাস লাগবে বলে ওই সময়ের পরে একই কথার পুনরাবৃত্তির মতো রাজনৈতিক আশ্বাসের চেয়ে ভ্যাকসিন উৎপাদনের মতো জটিল বিষয়ের ব্যবস্থাপনা, শিডিউলে নিবেদিত সিদ্ধান্তটা জরুরি পরিস্থিতিতে বেশি জরুরি।
উন্নত দেশগুলোতে ভ্যাকসিন কার্যক্রম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, ২-৩ মাসের মধ্যে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন হবে। টিকাদানে আমাদের অচলায়তন ভেঙে অগ্রগতিটা এই মুহূর্তে খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। টিকা আর স্বাস্থ্যবিধির যুগপৎ অভিযান ছাড়া বিকল্প পথ নেই। উন্নত দেশগুলোতে টিকাদানে অগ্রগতি সাপেক্ষে চাহিদা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর ভ্যাকসিনে এক্সেস বাড়বে। এই ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক লক্ষ্যে আমাদের ভ্যাকসিন সংগ্রহে মনোযোগী হওয়াটা ভীষণ জরুরি। এর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের টোল ম্যানুফেকচারিংয়ের সম্ভাব্যতা সঠিকভাবে যাচাই করে সামনে অগ্রসর হওয়াটাও জরুরী। ভ্যাকসিনের বিশ্বায়নে এবং এ সংক্রান্ত সুবিধা অর্জনে নিজেদের তাগিদটা মূল নিয়ামক। লেখক : কলামিস্ট, অনুজীব বিজ্ঞানী, কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত
আপনার মতামত লিখুন :