শিরোনাম
◈ হায়দার আকবর খান রনো মারা গেছেন ◈ ডোনাল্ড লু’র ছয়দিনের সফর শুরু, ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশ আসছেন ১৪ মে ◈ লোহাগড়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের মৃত্যু ◈ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাব পাস  ◈ জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টানা চার জয় বাংলাদেশের ◈ বন্দি ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলি বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের তথ্য-ছবি ফাঁস ◈ গাজার রাফাহজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা ও বোমাবর্ষণ ◈ কোনো ভর্তুকি ছাড়াই নিজস্ব আয় থেকে উড়োজাহাজের মূল্য পরিশোধ করছে বিমান ◈ আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলে বিএনপি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবে: ওবায়দুল কাদের ◈ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা শেষ, এখন চলবে ফাইজার: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর, ২০২০, ০৯:৪৮ সকাল
আপডেট : ১২ নভেম্বর, ২০২০, ০৯:৪৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: ফাইজারের করোনা ভ্যাকসিন নব্বই শতাংশ কার্যকরী, তবে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে অনেক

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: ৯ নভেম্বর ২০২০ দিনটি মানব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে দীর্ঘ দিন। করোনাভাইরাসের মহামারিতে গোটা বিশ^ যখন দিশেহারা ঠিক তখনই ফাইজার এবং বায়োন্টেক নিয়ে এলো শুভ সংবাদ, ঘোষণা দিলো যে তাদের উদ্ভাবিত এমআরএনএ ভ্যাকসিনটি করোনা প্রতিরোধে ৯০ শতাংশেরও বেশি কার্যকরী। আর এই ফলাফলটি এসেছে ৬টি দেশে চালানো তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অন্তর্বরতীকালীন ফলাফল পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে। এই ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী ৪৩ হাজার ৫০০ জন ভ্যাকসিন এবং প্ল্যাসিবো (ডামি ভ্যাকসিন) গ্রহিতার মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৯৪ জন। আসল ভ্যাকসিন এবং প্ল্যাসিবো গ্রহিতাদের ভেতরে সংক্রমিতের হিসেব কষে দেখা গেছে যে, প্রতি ১০০ জন ভ্যাকসিন গ্রহিতার ভেতরে ৯০ জনই রয়ে গেছে করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত। সাধারণত কোনো ভ্যাকসিন যদি ৭০-৭৫ শতাংশ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। তাহলে তাকেই কার্যকর ভ্যাকসিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথম দিকে বেশ অনিশ্চয়তার ভেতরে ছিলেন।

এতো অল্প সময়ে একটি কার্যকরী এবং নিরাপদ ভ্যাকসিন তৈরি করার কোনো ইতিহাস আমাদের নেই। বিশ^ব্যাপী ব্যাপক প্রাণহানী, সময় স্বল্পতা এবং মহামারির তীব্রতার কথা চিন্তা করে, বিজ্ঞানীমহল একমত হয়েছিলেন যে, যদি কোনো ভ্যাকসিন ৫০ শতাংশও কার্যকরী হয়, তাহলে সেই ভ্যাকসিনকে বিশেষ বিবেচনায় জনসাধারণে প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হবে। সেখানে ফাইজারের ভ্যাকসিনটির ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। ফাইজার আবার তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ের ফলাফল পর্যালোচনা করবে, যখন ভ্যাকসিন গ্রহিতাদের ভেতরে ১৬৪ জন করোনায় আক্রান্ত হবে। ধারণা করা হচ্ছে চ‚ড়ান্ত পর্বের ফলাফল পর্যালোচনায় ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে যেতে পারে। কোম্পানিটি আশা করছে এ বছরের শেষ নাগাদ তারা ৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে, যা থেকে যুক্তরাজ্য পাবে ১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন এবং বাকিটা পাবে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ এ দেশ দুটি ভ্যাকসিনের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছে। আগামী বছরের পুরোটা সময় জুড়ে ফাইজার বা বায়োন্টেক আরও ১৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে গোটা বিশ্বের জন্য। ফাইজারের এই খবরে আমাদের ভেতর যেমন উৎসাহ এবং আশার সঞ্চার হয়েছে, তেমনি কোম্পানিটির শেয়ারের দামও এক লাফে উঠে গেছে শীর্ষে! একটা বিষয় কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয়, ফাইজার তাদের ভ্যাকসিনটির শুধু কার্যকারিতার ফলাফল প্রকাশ করেছে। তবে ফলাফলের আরেকটি খুবই গুরত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ ভ্যাকসিনটির সেইফটি বা নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো রয়ে গেছে অজানা। যদিও তারা বলেছে যে তাদের ভ্যাকসিনটি কোনো প্রকার মারাত্মক বিরূপ প্রভাব প্রদর্শন করেনি, তবে এ ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি তারা কিছু বলেনি।

এর অবশ্য কারণও আছে। নিয়ম অনুযায়ী একটা ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর থেকে কমপক্ষে ২ মাস অপেক্ষা করতে হয়। কোনো প্রকার বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। ফাইজারকে এই তথ্য আহরনের জন্য আরও ২ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। আশা করা হচ্ছে নভেম্বরের শেষেই এই ফলাফল তারা ঘোষণা করবে। আর এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হবে ভ্যাকসিনটির অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফলের পূর্ণ বিবরণী। এছাড়াও ভ্যাকসিনটির কার্যকরিতার ব্যাপারে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো রয়ে গেছে অজানা। যেমন : [১] ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৪ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ভ্যাকসিন গ্রহিতাদের কতো জনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে, ট্রায়ালটিতে তা দেখা হয়নি। করোনা সংক্রমণ এবং কোভিড কিন্তু এক নয়। একজন মানুষ যখন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে তখন তাকে বলা হয় কোভিড। কিন্তু একজন যদি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়। কিন্ত রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করে তখন তাকে বলে অ্যাসিম্পটোমেটিক সংক্রমণ।

এ ধরনের অ্যাসিম্পটোমেটিক রোগীরা লক্ষণ প্রকাশ না করলেও ভাইরাসের বিস্তার ঘটায় একজন কোভিড রোগীর মতোই সমান তালে। ফাইজারের ভ্যাকসিনটি ৯০ শতাংশ কোভিড থেকে সুরক্ষা দিলেও তা কতোভাগ অ্যাসিম্পটোমেটিক সংক্রমণ প্রতিরোধ করে তা রয়ে গেছে অজানা। একটা ভ্যাকসিন যদি অ্যাসিম্পটোমেটিক সংক্রমণ কার্যকরভাবে প্রতিরোধ না করতে পারে। তাহলে সেই ভ্যাকসিন দিয়ে কিন্তু মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনা দুষ্কর। [২] আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ফাইজারের ভ্যাকসিনটি কী বৃদ্ধ মানুষের ওপর কার্যকরী। এর উত্তরটা এখনো অজানা। কোভিডে কিন্তু বৃদ্ধরাই মারা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। একটা ভ্যাকসিন যদি ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মানুষের ওপর কার্যকর না হয়। তাহলে কিন্তু ওই ভ্যাকসিন দিয়ে করোনায় গড় মৃত্যুহার তেমন একটা কমিয়ে আনা যাবে না। অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনিকা কিন্তু ফেইজ-২ ট্রায়ালের মাধ্যমে দেখিয়েছে যে, তাদের তৈরি চ্যাডক্স-(কোভিশিল্ড) ভ্যাকসিনটি বৃদ্ধ মানুষের ওপরে সমানভাবে কার্যকর।

[৩] এছাড়াও ভ্যাকসিনটি কতোদিন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে তাও রয়ে গেছে ভবিষ্যত গবেষণার বিষয়। [৪] ভ্যাকসিনটি যেহেতু একদম নতুন এবং অপরীক্ষিত প্লাটফর্মে তৈরি তাই এর দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা সম্পূর্ণ অজানা। ফাইজারের ভ্যাকসিনটি একটি এমআরএনএ প্লাটফর্মে তৈরি ভ্যাকসিন যা উৎপাদনের পর থেকেই সংরক্ষণ করতে হয় হিমাংকের অতি নিন্ম তাপমাত্রা-৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই তাপমাত্রায় সংরক্ষণ এবং সরবরাহ না করতে পারলে, ভ্যাকসিনের মূল উপাদান নিউক্লিক এসিড খুব তারাতারি ভেঙে যায় এবং এতে করে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই তাপমাত্রার এই সংবেদনশীলতাকে ভ্যাকসিন সরবরাহে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছেন। ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য এ ধরনের অতি শীতল (-৭০ ডিগ্রি) ধারক পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের ভ্যাকসিন কোল্ড চেইন সিস্টেমেই নেই। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের কোল্ড চেইন ব্যবস্থা বাংলাদেশ বা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে না থাকাই স্বাভাবিক।
ভ্যাকসিন সর্বরাহে এই প্রতিবন্ধকতাকে মাথায় রেখে ফাইজার তৈরি করেছে এক বিশেষ ধরনের ‘শীতল বাক্স’ বা ‘কুল বক্স’। ৫ হাজার ভ্যাকসিন ভায়াল ধারণ ক্ষমতার এই কুল বক্সের আঁকার হবে একটি ছোট সাইজের স্যুটকেসের সমান যার ভেতরে অতি শীতল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হবে ড্রাই আইসের বøক দিয়ে। এই কুল বক্সে এক নাগারে ১০ দিন -৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৫ হাজার ভায়াল ভ্যাকসিন সংরক্ষণ এবং সরবরাহ করা যাবে কোনো প্রকার ফ্রিজার বা বিশেষ কন্টেইনার ছাড়াই। এতে করে আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে কুল বক্সের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে দেশের প্রত্যন্ত আঞ্চলে। সুতরাং দেশের প্রচলিত কোল্ড চেইনে এই কুল বক্স অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে এমআরএনএ ভ্যাকসিন প্রদান সম্ভবপর হবে। আর এই কুল বক্স পুনঃব্যবহার যোগ্য, অর্থাৎ ড্রাই আইস দিয়ে এই বিশেষ কুল বক্স ব্যবহার করা যাবে বারবার। সব কিছু মিলিয়ে বলা যায় ফাইজারের ভ্যাকসিনটি এই মহামারিতে আশাজাগানিয়া এবং আশীর্বাদ স্বরূপ। তবে ভ্যাকসিনটির সুদূরপ্রসারী কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা সাবধানতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশের ভ্যাকসিন কোল্ড চেইনে পরিবর্তন আনার এখনই উপযুক্ত সময়। দেশে একটি কেন্দ্রীয় ড্রাই আইস কারখানা এবং -৮০ ডিগ্রী স্টোরেজ গড়ে তোলার উদ্যেগ সরকারকে এখনই নিতে হবে। ভ্যাকসিন বিশ্বে পরিবর্তনের জোয়ার এসেছে। এই পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশকেও খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
পরিচিতি : এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি ও সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়