কাকন রেজা : ধর্ষণ বিষয়ে আমার একটি লেখায় বলার চেষ্টা করেছিলাম, নির্দিষ্ট কোনো ধর্ষণের বিচার বা ধর্ষকের মৃত্যু কামনা করে লাভ নেই। আমাদের কথা বলতে হবে ধর্ষণ সহায়ক সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে। নুসরাত হত্যা ও ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষার্থীর ধর্ষণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অথচ তার কদিন না যেতেই খোদ রাজধানীতেই ঘটা আরেকটি নির্মমতা নিয়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিলো, ‘তুলে নিয়ে হাত-পা বেঁধে রাতভর ধর্ষণ, হাসপাতালে কাতরাচ্ছে শিশুটি’। মাত্র এগারো বছরের শিশুটিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে চার পাষ- এমন নির্মমতা ঘটিয়েছে। কই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীতো পথে নামেননি, বিচার চাননি। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়নি মানববন্ধন!
গত কদিনের আরও কয়েকটি শিরোনাম তুলে দিই, ‘তিন দিন নিখোঁজের পর ধানক্ষেতে মিললো কলেজ ছাত্রীর লাশ’, ‘ময়মনসিংহে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মাদ্রাসাছাত্রীকের গণধর্ষণ’, ‘পুলিশের হাত থেকে নিয়ে স্কুল ছাত্রীকে গণধর্ষণ’। তারা সবাই শিক্ষার্থী। আরও আছে। এ সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংঘটিত নির্মমতার পরের ঘটনা। বলি, এতো যে বিক্ষোভ দেখালেন, মানববন্ধন করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য, নুসরাতের জন্য, তাদের জন্য কেন করলেন না? অর্থাৎ আপনার কেউ আক্রান্ত হলে আপনি রাস্তায় নামবেন। কিংবা আপনি যে রাজনীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিফরম ধারণ করেন তার নির্দেশ হলে কিংবা তারা আক্রান্ত হলে আপনি পথে নামবেন, নইলে নয়। এটাকেই বলে ‘সিলেক্টিভ জাস্টিস’। আমার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হলে আমি আছি, নইলে নেই। এই সিলেক্টিভ জাস্টিস শুধু অবিচারের নামান্তর নয়, অপরাধের সহায়ক। অর্থাৎ একটি গোষ্ঠীকে অপরাধের অবাধ লাইসেন্স দেয়া। আর এই অপরাধের ভিক্টিম বেশিরভাগই গরিব-অসহায় মানুষ। কারণ তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, রাজনৈতিক ছাপ্পা নেই, তাদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া নির্মমতায় কেউ প্রতিবাদী হবে না। আপনারা যারা এই ধরনের সিলেক্টিভ প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন তারা কি আরেকটিবার ভেবে দেখবেন, সিলেক্টিভ জাস্টিসের এমন ক্ষতিকর দিক।
আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে কথা বলা প্রতিটি মানুষের ফরজ কাজ। সে যেই হোক, আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিচয় একটাই, মানুষ। যারা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় জানতে চান, আদর্শ ভেদের চিন্তা করেন তারা অসুস্থ। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্র, যা মানুষ হত্যার যজ্ঞ। সেখানেও আহত সৈনিককে হত্যায় নিষেধ রয়েছে। যে অন্যকে আঘাত করতে অক্ষম, তাকে হত্যা করা যুদ্ধেরও নীতি বহির্ভূত। অথচ আমাদের এখানে যখন অন্যরা আক্রান্ত হয়, সেই এগারো বছরের ছোট মেয়েটির মতন, যার প্রতিরোধের শক্তি নেই। তখন আমরা চুপ থাকি। চুপ থাকি এই কারণে যে, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় নেই, আদর্শিক অবস্থান নেই। সে বাম না, ডানও নয়। না ক্ষমতাশীন কিংবা ক্ষমতা প্রত্যাশী। সে শুধুই মানুষ। আশরাফুল মখলুকাত।
সৃষ্টির সেরা জীব। অমৃতের সন্তান। এর বিপরীতে স্বভাবত এবং সঙ্গতই প্রশ্ন উঠে, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় রয়েছে, আদর্শিক ছাপ্পা রয়েছে তবে কি তারা সৃষ্টির সেরা জীব বা অমৃতের সন্তান নয়? সিলেক্টিভ জাস্টিস আপনাকেও এমন প্রশ্নের সমুখে দাঁড় করাবে। ধর্ষণ সহায়ক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কারে, প্রয়োজনে প্রতিস্থাপনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের পরিচয়টা হারিয়ে ফেললে আপনার বা আমাদের অবস্থাও হবে ‘মার্টিন নিম্যুলারে’র সেই বিখ্যাত কবিতার শেষ লাইনের মতন, ‘দ্যান দে কেইম ফর মি অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ নো ওয়ান লেফ্ট টু স্পিক আউট ফর মি’। শেষে আপনার বা আমার জন্য কথা বলার সত্যিই কেউ থাকবে না। পুনশ্চ : লেখাটি শেষ করতে যাবো, এমন সময় চোখে পড়লো আরেকটি গণমাধ্যমের শিরোনাম, ‘চলন্ত বাসে ফের ধর্ষণের পর হত্যা, চালক আটক’। ‘চালক আটক’, শুনে মনে হতে পারে, এইতো ধরা পড়েছে, আর কী। এর আগেও এমন ধর্ষণকা-ে চালক ধরা পড়েছে। একজন নার্সের সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটেছিলো। সেখানেও ধর্ষকরা ধরা পড়েছে, বিচারও হয়েছে। তারপরেও কিন্তু থামেনি এমন কা-। ঢাকার ধামরাইয়ের এই হত্যাঘটনা তাই প্রমাণ করে। সুতরাং আমাদের গলদ রয়েছে অন্য কোথাও। খালি ধর্ষক গ্রেপ্তার আর ফাঁসির চিৎকার যার প্রতিকার নয়। গলদটা আমাদের ক্ষমতা কাঠামোতে। যেখান থেকে সমাজ আর রাষ্ট্র আক্রান্ত। এই কাঠামোর সংস্কার অতি জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :