ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : সাতচল্লিশ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, আবার অনেকটা পিছিয়েছেও! বিগত ৪৭ বছরে বাংলাদেশের অর্জন-বিয়োজন একই। আমাদের অর্জন কী এই সাতচল্লিশ বছরে? এদেশের জন্মলগ্নে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি হবে। সেই ঝুড়ি এখন উপচে পড়ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি সারাবিশে^র নজর কেড়েছে। সেদিক থেকে আমরা আত্মতৃপ্ত এবং আমরা জানি যে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাত্রা যথেষ্ট সন্তোষজনক। আগামীতে আরও ভালো হবে এমন একটি আশা পোষণ করছি আমরা। কিন্তু বিপরীতে রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উন্নয়ন বলতে যা বোঝায় তা এখনো হয়নি। কারণ প্রবৃদ্ধি হতে হবে সমতাভিত্তিক। তবেই উন্নয়ন পূর্ণতা পায়। বাংলাদেশে বৈষম্য বিরাজমান। অপরদিকে রাজনৈতিক অনুন্নয়ন আমাদের যথেষ্ট মর্মাহত করে। কারণ যতোই দিন যাচ্ছে রাজনৈতিক দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে, কাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু সেই গণতন্ত্র এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এজন্য যে শুধু আমরা সরকারি দলকেই দোষারোপ করবো তা নয়, বিরোধীদল বা বিরোধী মহল বলে যারা পরিচিত তারাও তাদের তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।
গণতন্ত্র দুই চাকার সাইকেলের মতো। এক চাকায় চলে না, দুই চাকায় চলতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে নড়বড়ে এক চাকার ওপরেই এই সাইকেলটি চলছে। সেদিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন প্রশ্নবিদ্ধ। গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এ কারণে যে বাংলাদেশে এখন রাজনীতি বলতে কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত যে রাজনীতি ছিলো দেশে বা বঙ্গবন্ধু আচরিত যে রাজনীতি ছিলো সে রাজনীতি এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজনীতির অর্থ বদলে গেছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশে এখন রাজনীতি নেই, আছে অর্থনীতি। ক্ষমতানীতি। ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় টিকে থাকা। এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। ছোটখাটো যে দলগুলো রয়েছে তারা চেষ্টা করে বড় দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ক্ষমতার ভাগিদার হওয়া যায় কিনা এবং সেই দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এবারের মন্ত্রিসভায় ছোট দলগুলো ছিটকে পড়লো। শুধু আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা হলো। এটাও ছোট দলগুলোর জন্য শিক্ষণীয় বিষয়। দাঁড়াতে হলে নিজের পায়েই দাঁড়াতে হয়, অন্যের কাঁদে ভর করে দাঁড়ানো ঠিক নয়। সব মিলিয়ে রাজনীতি অনেকটা পিছিয়ে আছে, অর্থনীতিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দুটির মধ্যে যে বৈপরিত্য তার সমাধান হওয়া উচিত। না হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে যাবে।
আওয়ামী লীগ তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। দলটি ক্ষমতায় থেকে দেশকে অনেক দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অপরদিকে বিএনপি কোনো রাজনীতিই করতে পারেনি। বিএনপির রাজনীতি বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিএনপি এখন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল নয় বরং বিবৃতিবাদী দলে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনীতিও নেই এখন বাংলাদেশে। গণতন্ত্রের জন্য এটি শুভলক্ষণ নয়। আমি আগেই বলেছিÑ গণতন্ত্র দুই চাকার সাইকেলের মতো। দুটি চাকাই সমানভাবে ঘুরতে হবে, সমানভাবে শক্তি প্রদর্শন করতে হবে। তবেই গণতন্ত্র সঠিক পথে চলতে শুরু করবে। বিএনপি সেটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নজরকাড়া। কিন্তু তা ভারসাম্যপূর্ণ নয়। কারণ বাংলাদেশে আয় বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠেছে। বৈষম্য শতভাগ নির্মূল করা যাবে তা আমি মনে করি না। তবে চেষ্টা করলে সহনীয় মাত্রায় সেই বৈষম্য নামিয়ে আনা যাবে। না পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কখনো ভারসাম্যপূর্ণ হয় না। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের একটা নির্বাচনী অঙ্গীকার আমরা দেখেছি। তারা সেখানে বলেছে, সমাজ থেকে বৈষম্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করবে। আমরা অপেক্ষায় আছি দেখার এ বিষয়ে তারা কতোটুকু সাফল্য অর্জন করতে পারে।
সন্ত্রাস ও মাদক দমনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের যথেষ্ট সাফল্য আছে এবং সারাদেশে নজর কেড়েছে তা। তবে সন্ত্রাস এবং মাদক একেবারে নির্মূল করা যাবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর কোনো দেশেই তা পারেনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে সন্ত্রাস কোনোদিক থেকেই যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ইয়াবার বিরুদ্ধে সরকারের যে যুদ্ধ সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ ইয়াবা স¤্রাট নামে খ্যাত যে বা যারা তাদেরকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে চুনোপুটিদের ধরলে মাদক নির্মূল হবে না। মাদকের আসল জায়গায় হাত দিতে হবে, যারা মাদক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন পয়ত্রিশ কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করছে সরকার প্রতিবছর। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় দারুণভাবে ধ্বস নেমেছে। কারণ বাংলাদেশে এখন শিক্ষার্থী নেই, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। একজন শিক্ষার্থীকে যদি সারাবছর পরীক্ষার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা হয় তার কোনো শেখ হয় না। শিক্ষায় সংখ্যাবাচক ব্যপ্তি ঘটেছে, কিন্তু গুণবাচক গভীরতা এখনো উদ্ধৃত হয়নি। তবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার তা আমি স্বাগত জানাই। পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তও পরীক্ষা থাকা উচিত নয়। পরীক্ষা যতো কমিয়ে আনা যায় ততোই ভালো। উপরন্তু শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে রক্ষা করতে হবে এজন্য যে হেফাজতে ইসলামের সুপারিশে পাঠ্যপুস্তুক থেকে সতেরটি রচনা সরিয়ে দিয়ে যে সমস্ত রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের নাগরিক তৈরি হবে না, পাকিস্তানের নাগরিক তৈরি হবে। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা দরকার। বাংলাদেশের উদ্দেশ্য, আদর্শ, লক্ষ্য উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে যে পরিমাণ মেধা, বুদ্ধি এবং চিন্তাভাবনা দরকার তার যথেষ্ট অভাব আছে।
রাষ্ট্র যদি সঠিক পথে না থাকে তাহলে সবকিছু বেঠিক পথে চলে যায়। শিক্ষার ব্যাপারে সরকার বা রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব ছিলো তা সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন। কিন্তু তার উদ্যোগ সঠিক পথে যাচ্ছিলো বলে মনে হয়নি। যেমন সৃজনশীল পদ্ধতির নামে যে প্রশ্নগুলো তৈরি করা হয়েছিলো তা আদৌ কোনো সৃজনশীল প্রশ্ন নয়। সরকার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষা কমিশন না করে একটা উপদেষ্টা পর্ষদ করতে পারে, যাতে যথার্থ শিক্ষাবিদেরা থাকবেন, সরকারি শিক্ষাবিদ নয়। যেকোনো সরকারের বিরুদ্ধে সব সময় অভিযোগ থাকবে। কিন্তু সরকারের কাজটি হচ্ছে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনা করা। সেই কাজটি সরকার করছে কিনা সেটি আমাদের বিবেচনা করতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষাবিদ বলেন, বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। কিন্তু সম্ভাবনাও রয়েছে বিপুল। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে হলে সঠিক নেতৃত্ব, সঠিক কর্মব্যবস্থাপনার প্রয়োজন আছে। আমরা এখন যে নেতৃত্ব পেয়েছি, বলা যেতে পারে যথেষ্ট সন্তোষজনক। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যথেষ্ট ভালো করছে। বিশ^ব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। উন্নয়ন-অগ্রগতির রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে যারা কাজ করছেন তারা সঠিকভাবে কর্মসম্পাদন করছেন বলে আমার মনে হয় না। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় যে, কোনো মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রী না থাকলেও শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে থাকলে বাংলাদেশটা অনেক ভালো চলতো। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উচ্চারিত একটি তির্যক মন্তব্য।
লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)