কাকন রেজা
এক.
অসহিষ্ণুতা দেখতে দেখতে আমজনতাও ক্রমশ অসহিষ্ণু উঠছে। 'মব জাস্টিস' বলে একটা কথা রয়েছে। জাস্টিস কোনো কারণে ফেইল করলে আমজনতা জাস্টিসের ভারটা হাতে তুলে নেয়। মোহাম্মদপুরে ধর্ষণরত যুবলীগ নেতাকে ধরে ধোলাই সেই 'মব জাস্টিসে'রই অংশ। ঢাকার রাস্তা মেয়েদের জন্য কতটা অনিরাপদ এই ঘটনাই তার প্রমান। কোন দেশে বাস করছি, যেখানে রাস্তায় একাকি মেয়েকে গাড়িতে তুলে নিয়ে রাস্তাতেই ধর্ষণ করা হয়! এমন অবস্থাতো একমাত্র 'আউট ল' দেশেই সম্ভব। ওয়েস্টার্নে পড়া তেমন দেশই কী আজ আমাদের জন্মভূমি! ‘বুনো পশ্চিমে’ মতো এখানেও কী অপরাধ হয় প্রকাশ্যে, অপরাধীর শাস্তিও প্রকাশ্যে! এ কোন দেশ দেখছি আমরা। তবে কী জাস্টিস শুধু ডিলেইড না, ডিনাইডও! জাস্টিস ডিনাইড না হলে ‘মব’ হবে কেনো!
যারা এমন ‘মবে’ মজা পেয়েছেন, বলছেন, ঠিক হয়েছে- তাদের ভাষার সাথে ক্রসফায়ার সমর্থকদের ভাষার কোনো তফাৎ নেই। 'লিঞ্চিং' কোনো ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুযোগ পেয়ে কাউকে পিটিয়ে হাতের সুখ মেটানো যায়, মনের সুখ মেটানো যায় কি? একদিনের হাতের সুখ মিটিয়ে কি ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে, যাবে না, যায় না। সারা বছর ভয়ে সিটিয়ে থাকবেন, আর সুযোগ পেয়ে হাতের সুখ মেটাবেন তাতো হয় না। নিজেকে প্রশ্ন করুন এই যে অহরহ ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে তা ঠেকাতে কবে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে রাস্তায় নেমেছেন, কবে ঘুমন্ত জাস্টিসকে জাগাতে গলা ছিড়ে শ্লোগান ধরেছেন, 'এসব বন্ধ করতে হবে'। না করেননি। যদি না করে থাকেন, তবে সুযোগ পেয়ে হাতের সুখ মেটানো কেনো!
ভেবে দেখুন, আপনার নিশ্চুপতা আর আপোষকামীতার জন্যেই ধর্ষণ এবং অপরাপর অপরাধ বেড়েছে, সাহস পেয়েছে দুর্বৃত্তরা। আপনার জন্যই সকল অপকর্ম করে পার পেয়ে যাচ্ছে রাবণেরর দল। এই দায় আপনার, আপনি বৃক্ষের মূলোৎপাটন করতে চাননি, পাতা ছিড়ে ‘চান্সে’ অক্ষমের রাগ ফলাতে চেয়েছেন।
দুই.
‘মব জাস্টিসে’র কথা বলছিলাম। ঘটনার কথা না বলতেই আরেকটি ঘটনা এসে হাজির। দুর্বৃত্তদের গুলিতে মারা গেলেন প্রকাশক, ব্লগার ও বামপন্থী নেতা শাহজাহান বাচ্চু। এমন মৃত্যুও কিন্তু ‘মব জাস্টিসে’র ধারাবাহিকতা। এটাও এক ধরণের ‘লিঞ্চিং’, ‘লিঞ্চিং মবে’র কান্ড। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে এই মৃত্যুর ‘বেনিফিশিয়ারি’ কে, এর উত্তর রয়েছে প্রজ্ঞা ও মেধার অনুশীলনে, সময়ের ধারাবাহিকতায়। তবে বেনিফিশিয়ারি যেই হোক, ঘটনা ঘটানোর পেছনে নিশ্চয়ই কারণ দাঁড় করানো হবে, হয়েছে। আর সেই কারণ অবশ্যই ধারণা প্রসূত এবং সেই ধারণাকে ভিত্তি করেই বিচার চুড়ান্ত করা হয়েছে। ‘মব জাস্টিসে’ যা হয়, ‘লিঞ্চিং মবে’ যেমন ঘটে।
কবি নবারুণ ভট্টাচার্য ’৭২ এ লিখেছিলেন,
‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না’
এই ২০১৮তে এসে আমাদের কোন কবি এমনটা লিখুক তা আমরা কেউই চাই না। আমরা চাইনা দেশে ‘মব জাস্টিসে’র আধিপত্যে ‘লিঞ্চিং মবে’র প্রসার ঘটুক। আমরা চাই, মানুষ শান্তিতে থাকুক, অন্তত স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাক।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
আপনার মতামত লিখুন :