ডেস্ক রিপোর্ট : থানচি থেকে রেমাক্রি হয়ে হাঁটাপথে এক দিনের পথ থুইসাপাড়া। নামে পাড়া হলেও এখানে সাকল্যে ১৯টি খেয়াং পরিবারের বসত। দেবতার পাহাড়ের আড়ালে সূর্য ডুব দেওয়ার আগেই থুইসাপাড়ার ঘরগুলোর সামনে চুলা জ্বলে। পুরো তিন দিন পাহাড়ের ওই এলাকায় থাকার অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত হওয়া গেল, কাঠ নয়, পাহাড়ের মানুষ রান্নাবান্নার কাজে বাঁশের অবশিষ্টাংশ এবং শুকনো লতাপাতা ব্যবহার করে থাকেন।
থুইসাপাড়ার কারবারি (সর্দার) থিংচু খেয়াং জানান, তারা কখনোই গাছ কেটে খড়ি করেন না। আগুনে গাছ পোড়ানো তাদের সমাজে রীতিমতো পাপ বলে গণ্য হয়। এর অবশ্য সমাজতাত্ত্বিক একটা কারণও রয়েছে। পাহাড়িরা জানেন, পাহাড় টিকে আছে গাছের জন্য। গাছ না থাকলে পাহাড় থাকবে না। তাদের জীবনও সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। পাহাড়ে বিকল্প জ্বালানি নেই বলে মরা গাছ কিংবা ডালপালা কেটে জ্বালানির চাহিদা মেটানো হয়। ঘর নির্মাণ করা হয় বাঁশ দিয়ে। কাঠের ব্যবহার পাহাড়ে নেই বললেই চলে।
হাঁটাপথে থুইসাপাড়া থেকে রেমাক্রি ফেরার পথে এ বক্তব্যের সত্যতা মেলে। নদীর তীর ধরে পাহাড়ের ঢাল পরিস্কার করে চাষাবাদ হচ্ছে। এতে পাহাড়ের খুব একটা ক্ষতি হয়, তেমন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। হাজার বছর ধরে এ প্রক্রিয়ায় পাহাড়ে চাষ করেন আদিবাসীরা, যা জুম চাষ নামে পরিচিত। জুম পদ্ধতিতে পাহাড়ের ঢালে একই সঙ্গে অনেক ধরনের শস্য চাষ করা হয়; যা পাহাড়ের পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু হাজার বছরের প্রাকৃতিক নিয়ম ভেঙে তামাক চাষের কারণে পাহাড়ের ক্ষতি হচ্ছে বেশি। প্রতি বর্ষায় শঙ্খ নদের স্রোতে ভাঙে পাহাড়ের পাদদেশের বালুর তীর। গহিন অরণ্যের দুর্গমতার কারণে সেখানে বন টিকে থাকলেও লোকালয়ের কাছাকাছি বনের গর্জন, বহেড়া, চাম্পা ফুল, হরীতকীসহ নানা প্রজাতির গাছ পড়ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের করাতে। যাচ্ছে ইটভাটায়। পর্যটকদের পাহাড় ঘুরিয়ে দেখান প্রকাশ দাস। তিনি জানান, পাহাড়িরা সচরাচর গাছ কাটে না। গাছ কাটে সমতল থেকে আসা কাঠ ব্যবসায়ীরা। টাকার লোভে এ কাজে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পাহাড়িও জুটেছে। এতে বন ও পাহাড়ের ক্ষতি হচ্ছে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসনের তথ্য, জেলায় নিবন্ধিত ও অবৈধ মিলিয়ে ইটভাটার সংখ্যা ৫৬। লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে রয়েছে ২৭টি ইটভাটা। এগুলোতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতি বছর প্রতিটি ভাটায় ১০ বারের মতো ইট পোড়ানো হয়। প্রতিবারে ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ইট তৈরি করা হয়ে থাকে। এতে তিন থেকে চার হাজার টন কাঠ প্রয়োজন হয়। প্রতিটি ইটভাটায় বছরে কাঠ পোড়ানো হয় ৩০ হাজার টন। এই হিসাবে জেলার ৫৬টি ইটভাটায় ১৮ লাখ টন কাঠ পোড়ানো হয়। এসব কাঠ সংগ্রহ করা হয় পাহাড়ের বনভূমি থেকে। জেলা কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি চহদ্মা প্রু জিমি জানান, দেড় যুগ আগে কাঠ ব্যবসায়ী ছিলেন হাতেগোনা। বর্তমানে সংখ্যা কত রয়েছে তা জানাতে না পারলেও তার ধারণা, সংখ্যাটি দুই শতাধিক।
লামা সদর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে ফাইতং ইউনিয়ন। সেখানে গিয়ে দেখা যায় এক জায়গাতেই ২১টি ইট ভাটা। ইট তৈরি করতে চুল্লিতে দেওয়া হচ্ছে বনের গাছ। জ্বালানি হিসেবে বনের গাছ কেটে স্তূপ করে রাখা হয়েছে এবং পাহাড় কেটে চুল্লির পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে মাটি। এসব ইটভাটায় মাটি কাটার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে বুলডোজার আর এক্সক্যাভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র)। এখানে কথা হয় একটি ইটভাটার ম্যানেজারের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ম্যানেজার বলেন, ইটভাটায় পাহাড়ের গাছ ও লাকড়ি ব্যবহার করি। কারণ কয়লা দিয়ে ইট পোড়ালে খরচ বেশি হয়। ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি কবির আহম্মদ বলেন, লাখ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেই ব্যবসা করছি। ১৩টি ইট ভাটার জন্য হাইকোর্টে রিট করেছি। অন্যগুলোও এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
পাহাড়ে একসময় কৃষি বলতে ছিল জুম চাষ। সারা বছরের খাদ্যের জোগান হতো জুম থেকে। জুম চাষিরা বিশেষ কায়দায় পাহাড়ে চাষ করতেন। কিছু গাছ কাটা পড়ত বটে, তবে বড় গাছে করাত পড়ত না। জুম ছেড়ে এখন ফলদ বাগানে ঝোঁক তাদের। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক আলতাফ হোসেনও জানান, পাহাড়ে জুম চাষ কমছে। কৃষকদের অনেকেরই চাষাবাদ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রয়েছে। তাই জুম পাহাড়ের ক্ষতির কারণ নয়; বরং পাহাড়িরা জুম চাষ ছেড়ে দেওয়ায় পাহাড়ের ক্ষতি হচ্ছে, এ কথাও মানলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক।
জুম চাষির সংখ্যা কমলেও বাড়ছে কাঠ ব্যবসায়ী ও ইটভাটার সংখ্যা। তাদের করাতে দেদার গাছ উজাড় হচ্ছে বলে জানালেন থানচি থেকে ফেরার পথে চান্দের গাড়ির চালক দেবাশীস রায়। তিনি বাঙালি, তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা থানচির পাহাড়ের কোলে বলিপাড়া গ্রামে। দেবাশীসের ভাষ্য, কক্সবাজারের চকরিয়ার কেরানির হাট থেকে খুব দূরে নয় থানচি। সেখানে আলীকদম, লামা হয়ে থানচি পর্যন্ত সড়ক হয়েছে। সমতলের ইটভাটার জ্বালানি যায় আলীকদম ও থানচির পাহাড়ি এলাকা থেকে। আলীকদমের পথে দেখা যায়, সমতল লাগোয়া পাহাড় কয়েক বছরের তুলনায় অনেকটাই ন্যাড়া। গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করার কারণেই গত বর্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধসে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল, যার ক্ষত এখনও বইছে রাঙামাটিতে। আলীকদম সড়কেও সেবারের ভূমিধসের ক্ষত রয়েছে।
মারমা ভাষা গবেষক ও লেখক ক্যশৈ প্রুর কণ্ঠে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। বান্দরবানে খোকা স্যার নামে পরিচিত এই লেখক বলেন, পাহাড়িদের স্বপ্ন দেখতে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে নতুন নতুন রাস্তা হলে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো বাজার পাবে। তাদের এলাকার উন্নয়ন হবে। তবে পাহাড়ের রাস্তা যতটা না পাহাড়িদের উপকারে লাগছে, তার চেয়ে বেশি ব্যবহূত গাছসহ পাহাড়ের সম্পদ আহরণে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির জেলা আহ্বায়ক জোয়াম লিয়ান আমলাই জানান, শত শত বছর ধরে পাহাড়ে বাস করছে আদিবাসীরা। বেঁচে থাকার জন্যই তারা পাহাড়ের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়ে কীভাবে বসবাস করতে হয়, তা তারা জানে। পাহাড়কে অত্যাচার না করে, বন ধ্বংস না করে জীবন ধারণের কৌশল তাদের জন্মগতভাবে রপ্ত। কিন্তু সমতলের মানুষ তা জানে না।
প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছে তাজিংডং নামে একটি স্থানীয় এনজিও। এই এনজিওটির নির্বাহী পরিচালক চাই সিং মং বলেন, জুম চাষে বন ধ্বংস হয়নি। হয়েছে কাঠ ও পাথর ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভে। জুম চাষিরা খাদ্যের জোগান দিতে ছোট কিছু গাছ কাটেন; কিন্তু ব্যবসায়ীরা বন উজাড় করেন।
ভিলেজ ফর কমন ফরেস্ট (ভিসিএফ) নিয়ে কাজ করছেন সদর উপজেলা রেনিক্ষ্যং বাগানপাড়ার বাসিন্দা প্রান্তে ম্রো। তার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তাদের পাড়ায় ৩২টি ম্রো পরিবারের ৪০ একর বন রয়েছে। সেখানে সব প্রজাতির গাছ সংরক্ষণ করছেন আদিবাসীরা। বন রক্ষায় কমিটিও রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে পাড়ার বাসিন্দারা কাঠ, বাঁশ ও জ্বালানি সংগ্রহ করেন বন থেকে। বন থাকায় ঝিরিতে সারা বছর পানি থাকে। এ শিক্ষা তারা প্রকৃতি থেকেই পেয়েছেন। তিনি জানান, বান্দরবানের সাত উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিসিএফ আছে রোয়াংছড়ি উপজেলায়। যেখানে বন নেই, সেখানে ঝিরিগুলোতে সারা বছর পানি থাকে না। শুস্ক মৌসুমে পানির খুব কষ্ট হয়।
বন বিভাগের বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বিপুল কৃষ্ণ দাস বলেন, জুম চাষ বনের ক্ষতি করে। তবে আগের তুলনায় এখন পাহাড়ে জুম চাষ কমে গেছে। আমরা নতুন বন সৃষ্টির চেষ্টা করছি এবং বন ধ্বংসকারীদের প্রতিরোধে সক্রিয় রয়েছি। স্থানীয় অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। লোকবলও প্রয়োজনের তুলনায় কম। তবে বন উজাড়কারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
পাহাড়ি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা কৃষি অধিদপ্তরের কোনো প্রতিষ্ঠানে জুম চাষিদের কোনো পরিসংখ্যান বা কোনো ধরনের তথ্য নেই। তবে, ইউএনডিপির এক গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে, আদিবাসীদের এখনও শতকরা আশি ভাগই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষের ওপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত নৃবিজ্ঞান প্রকল্পের আওতায় একটি গবেষণা হয়েছিল। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, জুম চাষের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে, এমন একটি জোরালো প্রচারণা রয়েছে। বিষয়টিকে স্পষ্টতই ক্ষতিগ্রস্তদের ওপর দোষ চাপানোর কৌশল বলে মনে হয়। এ অবস্থ্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বন বিনাশের ফলে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে, তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও অসংগঠিত জুমিয়া কৃষকদের প্রতি দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া অবশ্যই সুবিধাজনক। বন উজাড় হয়ে যাওয়া ও বনভূমি বেহাত হয়ে যাওয়ায় জুমিয়া কৃষকরাই সবার আগে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, জুম চাষের কারণে পাহাড়ের ক্ষতি হয় এ তত্ত্বটি হাস্যকর। পৃথিবীর বহু দেশে জুম চাষ হচ্ছে। যারা শহরে থাকে, তারা গ্রামের মানুষকে আলু চাষ শেখাতে চায়। জুম চাষের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ প্রোপাগান্ডা চলাচ্ছে অজ্ঞতা কিংবা ব্যবসায়িক উদ্দেশে। পাহাড়ে জুম চাষ বন্ধ করতে পারলে পাহাড় দখল করে রিসোর্ট ও রাবার বাগান বানানো যাবে এবং পাহাড়ি বনের গাছ চুরি করা যাবে। ফলে একটি যুক্তি দেখিয়ে পাহাড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, পাহাড়ে সমতলের মতো যুক্তি চলবে না। পাহাড়ে সনাতনী কিংবা পাহাড়িদের মতোই চাষাবাদ করতে দেওয়া উচিত। সবকিছুকে অর্থমূল্যে বিবেচনা করলে হবে না। পাহাড়িদের জন্য পাহাড়-বন হাজার বছরের আবেগ-অনুভূতির জায়গা, আর বহিরাগতদের জন্য লুটতরাজের জায়গা। ফলে পাহাড় ও পাহাড়িদের প্রকৃতির নিয়মেই থাকতে দেওয়া উচিত। সূত্র : সমকাল