আজকের ডিজিটাল বিশ্বে ইন্টারনেট আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যোগাযোগ, বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যাংকিং ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ—সবকিছুই এখন অনলাইন-নির্ভর। এই সহজলভ্যতার অপর পিঠেই রয়েছে অন্ধকার এক জগৎ, আর তা হলো সাইবার অপরাধ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু সাধারণ অভ্যাসই অজান্তে খুলে দিচ্ছে সাইবার অপরাধীদের জন্য দরজা, যার মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, অর্থ এবং মানসিক শান্তি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য সচেতনতাই পারে আমাদের বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ৫টি মারাত্মক অভ্যাস, যা আপনাকে সাইবার অপরাধীদের নিশানায় পরিণত করছে।
অভ্যাস: মনে রাখার সুবিধার জন্য অনেকেই ফেসবুক, ই-মেইল, অনলাইন ব্যাংকিং, এবং অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একই বা প্রায় কাছাকাছি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন।
ঝুঁকি: এটি সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর একটি। বিভিন্ন সময়ে বড় বড় কোম্পানির ডেটাবেস হ্যাকারদের কবলে পড়ে, যা "ডেটা ব্রিচ" (Data Breach) নামে পরিচিত। যখন কোনো একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে আপনার পাসওয়ার্ড ও ইউজারনেম ফাঁস হয়ে যায়, হ্যাকাররা সেই তথ্য ব্যবহার করে আপনার অন্য সব অ্যাকাউন্টে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়াকে "ক্রেডেনশিয়াল স্টাফিং" (Credential Stuffing) বলা হয় এবং এটি অত্যন্ত কার্যকর একটি হ্যাকিং কৌশল।
করণীয়:
প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা এবং শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করুন।
শক্তিশালী পাসওয়ার্ডে বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং প্রতীক (!, @, #, $, %)-এর মিশ্রণ রাখুন।
একাধিক পাসওয়ার্ড মনে রাখতে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার (যেমন: Bitwarden, LastPass, 1Password) ব্যবহার করুন।
অভ্যাস: শপিং মল, বিমানবন্দর, ক্যাফে বা রেস্তোরাঁর ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করা এখন খুবই সাধারণ একটি বিষয়। অনেকেই এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সংবেদনশীল কাজ, যেমন—ব্যাংকিং লেনদেন, ব্যক্তিগত ই-মেইল চেক করা বা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল আদান-প্রদান করেন।
ঝুঁকি: পাবলিক ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কগুলো সাধারণত এনক্রিপ্টেড বা সুরক্ষিত থাকে না। ফলে, একই নেটওয়ার্কে থাকা কোনো হ্যাকার সহজেই আপনার ডিভাইসের ডেটা ট্র্যাফিক পর্যবেক্ষণ করতে পারে। "ম্যান-ইন-দ্য-মিডল" (Man-in-the-Middle) আক্রমণের মাধ্যমে তারা আপনার পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য এবং ব্যক্তিগত মেসেজ হাতিয়ে নিতে পারে।
করণীয়:
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করতেই হলে ভিপিএন (VPN - Virtual Private Network) ব্যবহার করুন। ভিপিএন আপনার ডেটা এনক্রিপ্ট করে সুরক্ষিত রাখে।
এই ধরনের নেটওয়ার্কে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন বা ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান থেকে বিরত থাকুন।
অভ্যাস: ই-মেইল, হোয়াটস্যাপ, মেসেঞ্জার বা সোশ্যাল মিডিয়ায় লোভনীয় অফার, পুরস্কার জেতার বার্তা বা ভীতি প্রদর্শনকারী কোনো মেসেজের সাথে পাঠানো লিংকে যাচাই না করেই ক্লিক করা।
ঝুঁকি: এই কৌশলটি "ফিশিং" (Phishing) নামে পরিচিত। হ্যাকাররা নামীদামী প্রতিষ্ঠানের ছদ্মবেশে লিঙ্ক পাঠিয়ে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন—ইউজারনেম, পাসওয়ার্ড বা ক্রেডিট কার্ডের বিবরণ চুরি করার চেষ্টা করে। এছাড়া, এই লিংকে ক্লিক করার মাধ্যমে আপনার ডিভাইসে র্যানসমওয়্যার, স্পাইওয়্যার বা ভাইরাসের মতো ক্ষতিকর ম্যালওয়্যার (Malware) ইনস্টল হয়ে যেতে পারে।
করণীয়:
কোনো লিংকে ক্লিক করার আগে প্রেরকের পরিচয় এবং লিংকের ঠিকানা (URL) ভালোভাবে যাচাই করুন।
অপ্রত্যাশিত বা লোভনীয় অফারের মেসেজ এড়িয়ে চলুন।
সন্দেহজনক মনে হলে কোনো লিংকে ক্লিক না করে মেসেজটি ডিলিট করে দিন।
অভ্যাস: মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে আসা অপারেটিং সিস্টেম (OS) বা অ্যাপ্লিকেশনের আপডেট নোটিফিকেশন উপেক্ষা করা বা পরে করবেন ভেবে ফেলে রাখা।
ঝুঁকি: সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো নিয়মিত আপডেটের মাধ্যমে তাদের সিস্টেমে থাকা নিরাপত্তা ত্রুটি বা "ভালনারেবিলিটি" (Vulnerability) ঠিক করে। আপনি যখন এই আপডেটগুলো এড়িয়ে যান, তখন আপনার ডিভাইসটি পুরনো এবং असुरক্ষিত অবস্থায় থেকে যায়। হ্যাকাররা এই নিরাপত্তা ছিদ্রগুলো খুঁজে বের করে সহজেই আপনার ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।
করণীয়:
আপনার কম্পিউটার, মোবাইল এবং অন্যান্য স্মার্ট ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে সর্বদা আপ-টু-ডেট রাখুন।
সম্ভব হলে "অটোমেটিক আপডেট" (Automatic Update) অপশনটি চালু করে রাখুন।
অভ্যাস: জন্মতারিখ, পুরো নাম, কর্মস্থল, বাড়ির ঠিকানা, সন্তানের স্কুলের নাম বা লাইভ লোকেশন ট্যাগ করে ঘন ঘন ছবি ও স্ট্যাটাস পোস্ট করা।
ঝুঁকি: আপনি যা কিছু শেয়ার করছেন, তা হ্যাকারদের জন্য "সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং" (Social Engineering)-এর মূল্যবান উৎস। আপনার দেওয়া ছোট ছোট তথ্য মিলিয়ে তারা আপনার পাসওয়ার্ড অনুমান করতে পারে, আপনার নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে অথবা ফিশিং আক্রমণের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করতে পারে। যেমন—আপনার পোষা প্রাণীর নাম বা জন্মস্থান প্রায়ই পাসওয়ার্ড রিকভারির নিরাপত্তা প্রশ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
করণীয়:
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রাইভেসি সেটিংস ব্যবহার করে আপনার পোস্ট কারা দেখতে পারবে তা নিয়ন্ত্রণ করুন।
জন্মতারিখ, ফোন নম্বর বা বাড়ির ঠিকানার মতো সংবেদনশীল তথ্য পাবলিক করা থেকে বিরত থাকুন।
অপরিচিত কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার আগে তার প্রোফাইল যাচাই করুন।
সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহারকারীর সচেতনতাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। উপরের অভ্যাসগুলো পরিবর্তনের পাশাপাশি নিচের বিষয়গুলো মেনে চলা জরুরি:
টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন (2FA) চালু করুন: পাসওয়ার্ড চুরি হলেও 2FA আপনার অ্যাকাউন্টে একটি অতিরিক্ত সুরক্ষা স্তর যোগ করে।
নিয়মিত ডেটা ব্যাকআপ রাখুন: র্যানসমওয়্যার আক্রমণের শিকার হলেও আপনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেন হারিয়ে না যায়, তার জন্য নিয়মিত ব্যাকআপ রাখুন।
সচেতন থাকুন: যেকোনো অনলাইন কার্যক্রম করার আগে দুবার ভাবুন। কোনো কিছু অস্বাভাবিক মনে হলে সতর্ক হন।
আপনার ডিজিটাল নিরাপত্তা আপনারই হাতে। সামান্য সতর্কতা এবং কিছু ভালো অভ্যাসই পারে আপনাকে সাইবার দুনিয়ায় সুরক্ষিত রাখতে।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ সরকারের বিজিডি ই-গভ সার্ট (BGD e-GOV CIRT) কর্তৃক প্রকাশিত সাইবার নিরাপত্তা নির্দেশিকা।
আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা যেমন: Kaspersky, Norton, এবং McAfee-এর গবেষণা ও প্রতিবেদন।
স্বনামধন্য প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম যেমন: TechCrunch, Wired, এবং ZDNet-এ প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণ।