শিরোনাম
◈ খালেদা জিয়ার কবর খোঁড়ার প্রস্তুতি চলছে ◈ খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে যা বলছে ভারতের মিডিয়া ◈ জাতির সংকটময় মুহূর্তে খালেদা জিয়ার প্রয়াণ ‘বিরাট ক্ষতি’: প্রধান উপদেষ্টা ◈ তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও কাল বুধবার সাধারন ছুটি ঘোষণা ◈ তার সেই মহান উক্তি ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই’ (ভিডিও) ◈ খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন শেখ হাসিনা ◈ খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিপিএলের আজ‌কের খেলা স্থগিত ◈ খালেদা জিয়া গৃহবধূ থেকে যেভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নেতা হয়ে উঠেছিলেন  ◈ শহীদ জিয়ার পাশেই শায়িত হবেন খালেদা জিয়া ◈ আজ দুপুর ১২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

প্রকাশিত : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৮:২৫ সকাল
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০১:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আপোসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া

বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি ১৯৯১-১৯৯৬ সাল এবং ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বেনজির ভুট্টোর পর মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী।

১৯৭৭ সালে তার স্বামী জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিত হন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যার শিকার হলে খালেদা রাজনীতিতে যোগ দেন এবং বিএনপির নেতৃত্বে আসেন। ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, তিনি গণতন্ত্রের জন্য চলমান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯৬-এর স্বল্পস্থায়ী বিতর্কিত সরকারেও তিনি দায়িত্বপালন করেন, যেখানে অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনটি বর্জন করেছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ২০০১ সালে তার দল পুনরায় ক্ষমতায় আসে এবং তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

২০০৬ সালে তার সরকারের নির্ধারিত শাসনকাল শেষ হওয়ার পর, ২০০৭ সালে নির্ধারিত নির্বাচন রাজনৈতিক সহিংসতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে বিলম্বিত হলে, সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। সেই সরকারের সময়কালে, খালেদা জিয়া তার দুই সন্তান-সহ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন। ২০১৮ সালে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা এবং ২০১৮ সালে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জিয়াকে মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল তাকে কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২০২০ সালের মার্চে মানবিক কারণে তাকে ছয় মাসের জন্য গৃহবন্দি করে মুক্তি দেয় শেখ হাসিনা সরকার এবং রাজনীতিতে কোনো ধরণের সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তীকালে, জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাহী আদেশে খালেদার দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন। ২৭ নভেম্বর ২০২৪, খালেদা দুর্নীতি মামলা থেকে খালাস পান।

প্রারম্ভিক জীবন

১৯৭৯ সালে খালেদা জিয়া
বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম নাম খালেদা খানম পুতুল।দিনাজপুরে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ভাইয়েরা সবার ছোট। তার পিতামহ হাজী সালামত আলী, মাতামহ জলপাইগুড়ির তোয়াবুর রহমান। বাবা জনাব ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়া। আদি পৈতৃকনিবাস ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মজুমদার বাড়ী। বাবা জনাব ইস্কান্দর মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ইস্কান্দার মজুমদার ১৯১৯ সালে ফেনী থেকে জলপাইগুড়ি যান। বোনের বাসায় থেকে মেট্রিক পাস করেন ও পরে চা ব্যবসায়ে জড়িত হন। ১৯৩৭ সালে জলপাইগুড়িতে বিয়ে করেন। জলপাইগুড়ির নয়াবস্তি এলাকায় ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন এবং ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন একান্তভাবে একজন গৃহিণী । তিনি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেই থাকতেন। খালেদা পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুরের মিশন স্কুলে ভর্তি হন এরপর তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। একই বছর তিনি জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে তিনি খালেদা জিয়া বা বেগম খালেদা জিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি স্বামীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তান এ বসবাসের পূর্বে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ এ পড়াশোনা করেন।

তার স্বামী বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিয়ে হয়। জিয়া তখন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডি এফ আই এর কর্মকর্তা রূপে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। তার এক ভাই মেজর(অবঃ) সাঈদ এস্কান্দার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল থেকে ফেনী-১ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় তারেক রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালায়া হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। আরাফাত রহমান একজন ব্যবসায়ী ছাড়াও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও সিটি ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন।

১৯৬৫ সালে খালেদা জিয়া স্বামীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান)যান। ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত করাচিতে স্বামীর সাথে ছিলেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন জয়দেবপুর থাকার পর চট্টগ্রামে স্বামীর কর্মক্ষেত্র স্থানান্তরিত হলে তার সঙ্গে সেখানে এবং চট্টগ্রামের ষোলশহর অঞ্চলে বসবাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভকালে খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি পান। রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত বেগম জিয়া একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন। মূলত দুই পুত্রকে লালন পালন ও ঘরের কাজ করেই সময় কাটাতেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও রাজনীতিতে বেগম জিয়ার উপস্থিতি ছিল না।

প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবন

১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীদের আহ্বানে তিনি ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। বেগম জিয়া এর বিরোধিতা করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলত বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন

১৯৮৩ সালের বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ হয়। বেগম জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনেরো দলের সাথে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচির সূত্রপাত করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া "এরশাদ হটাও" শীর্ষক এক দফার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। তারপর পুনরায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উপক্রম হয়। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর অবিরাম, নিরলস ও আপোসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।

১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। ২ এপ্রিল তিনি সংসদে সরকারের পক্ষে এই বিল উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ কে স্বপদে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল আনেন। ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালের সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিল পাশ হয়।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। যা পরবর্তীতে ৯৬ এর একদলীয় নির্বাচন হিসেবে গণ্য হয়। সকল বিরোধীদলের আপত্তির পর ও খালেদা জিয়া ও তার দল এই একক নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগ সহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বয়কট করে। এই সংসদ মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। খালেদা জিয়া এই সংসদের ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রবল গণ আন্দোলন ও বর্হিবিশ্বের চাপে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির সাথে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া এই সংসদেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।

১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মোট ১১৬ আসনে জয় লাভ করে, যা সরকার গঠনে যথেষ্ট ছিল না। আওয়ামী লীগ মোট ১৪৭ আসন লাভ করে, তারা জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি সপ্তম সংসদে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর শাসনকালে সংসদে বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন।

তিনি ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর ৩ তারিখে দুর্নীতির অভিযোগে পুত্রসহ আটক হন।২০০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বার তিনি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক বন্দী হবার পর দীর্ঘ এক বছর সাত দিন কারাগারে অবস্থানকালে তার বিরুদ্ধে চলতে থাকা কোন অভিযোগেরই উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি এবং চলতে থাকা তদন্তে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে যেখানে জিয়ার দল আওয়ামী লীগ এবং তার মহাজোটের কাছে হেরে যায় যা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়েছিল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন, এবং তার দল ২০০৯ সালের প্রথম দিকে সরকার গঠন করে। জিয়া সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন।

জিয়ার দল একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত না হওয়া পর্যন্ত ২০১৪ সালের বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার একটি অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে তার ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।এরপরই তাকে বন্দী করে ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০২৪ সালে এই মামলাতেও তিনি খালাস পান।

১৩ নভেম্বর ২০১০ বেগম জিয়া তার ২৮ বছরের আবাসস্থল ছেড়ে যান। তিনি অভিযোগ করেন যে তাকে বলপ্রয়োগে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে জিয়াউর রহমানের সাথে শহীদ মইনুল সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে ওঠেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে ১২ জুন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার সেনানিবাসের ওই বাড়িটি খালেদার নামে বরাদ্দ দেন।

২০১২ সালে বেগম খালেদা জিয়া একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর করেন। আগস্টে তিনি রাজ পরিবারের আমন্ত্রণে সৌদি আরবে যান এবং পবিত্র ওমরাহ পালন করেন। এই সফরে তিনি সৌদি রাজপুত্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদের সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের বৈঠকে দ্বিদেশীয় সম্পর্ক ও সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রম বাজারের সংকট উত্তরণের বিষয়ে আলোচনা হয়।

অক্টোবরে খালেদা জিয়া চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সফর করেন। সফরকালে তিনি চীনের রাষ্ট্রীয় ও দলীয় ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করেন। চীনের উপ-রাষ্ট্রপতি ও ভবিষ্যত একচ্ছত্র নেতা শি জিনপিংয়ের সাথে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও পদ্মা সেতু নির্মাণে বিনিয়োগের ব্যাপারে আলোচনা করেন। বৃহত্তর অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বিষয়াবলিও তাদের আলোচনায় উঠে আসে। শি জিনপিং ছাড়াও খালেদা জিয়া কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রধান ওয়াং চিয়ারুইয়ের সাথে দেখা করেন। উল্লেখ্য এ বছরের মাঝামাঝিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্য মূল অর্থদাতা বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলে বিশ্ব ব্যাংককে অনুসরণ করে একাধিক দাতা সংস্থা ঋণদান থেকে সরে দাঁড়ায় ও প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।

বেগম জিয়ার চীন সফর সম্পন্ন হওয়ার একদিন পর তার রাজনৈতিক দল বিএনপি ঘোষণা দেয় যে চীনা নেতৃবৃন্দ দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে চীন সরকারের বিনিয়োগের বিষয়ে খালেদা জিয়াকে নিশ্চিত করেছেন।

একই মাসে খালেদা জিয়া ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ভারত সফরে যান। সফরের শুরুতে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় বিরোধী দলীয় প্রধান ও বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের সাথে বৈঠক করেন। সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খুরশিদ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন ও পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন । খালেদা জিয়ার ভারত সফরের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল দ্বিদেশীয় সম্পর্ক, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, তিস্তা পানি চুক্তি এবং বৃহত্তর অঞ্চলের ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তা।

অসুস্থতা

জিয়া দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অবস্থা, পচনশীল যকৃতের রোগ, অস্থির হিমোগ্লোবিন, ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং অন্যান্য বয়সজনিত জটিলতায় ভুগছেন। ২০২১ সালের এপ্রিলে খালেদা জিয়া করোনা-ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তার বাসা ফিরোজার আরো ৮ জনের করোনা-ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। ২০২২ সালে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি জিয়াকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) থেকে স্থানান্তর করা হয়। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার সিধান্ত নেন।

২০২৫ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমীরের পাঠানো বিশেষ এয়ার এম্বুলেন্সে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছান। ২৩শে নভেম্বর ২০২৫ তারিখে, খালেদা জিয়াকে 'খুবই গুরুতর' অবস্থায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

মুক্তি
২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর তিনি মুক্তি পান। ৫ আগস্টের মুক্তির কিছুদিন পর ১৯ আগস্ট ২০২৪ সালে, জিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, যা ২০০৭ সাল থেকে জব্দ করা হয়েছিল, তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দ্বারা অবরোধ মুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

২ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে, সরকার তাকে ভিভিআইপি ঘোষণা করে এবং তার নিরাপত্তার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে।

পদক ও সম্মাননা

২০১১ সালের ২৪ শে মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ’ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ পদক প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোন বিদেশিকে এ ধরনের সম্মান প্রদানের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম।

পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সম্মাননা দেয় কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) নামের একটি সংগঠন। 

আটক
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য রূপে দলে যোগ দেবার পর থেকে মোট পাঁচ বার তিনি আটক হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর আটক হন।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় (১ সেপ্টেম্বর ২০০৭) দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হন।প্রায় এক বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন।২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পান। 

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতির মামলা (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা) দেখিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।প্রথমে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড কারাগারে বন্দি ছিলেন, পরে স্বাস্থ্যগত কারণে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রাখা হয়।প্রায় দীর্ঘ ২ বছরেরও বেশি সময় তিনি কার্যত কারাগারে ছিলেন। ২৫ মার্চ ২০২০-এ সরকার শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয় (কারাগারের সাজা স্থগিত করে বাসায় চিকিৎসার অনুমতি দেয়)। তবে এটিও পুরোপুরি মুক্তি নয়, আইনি শর্তে গৃহবন্দিত্বের মতো অবস্থা ছিল। ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত তাকে রাজনৈতিকভাবে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছিল। 

সমালোচনা
আওয়ামী লীগ শাসনামলে জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলা ও নাইকো দুর্নীতি সহ বিভিন্ন মামলায় তার নামে আসে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে, খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছরের কারাবাসের দণ্ডপ্রাপ্ত হন। এতে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন একটি এতিমখানা ট্রাস্ট গঠনের সময় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর সকল মামলা থেকে তিনি মুক্তি পান। রাষ্ট্রপতির আদেশে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি পাঁচই অগাস্টের পর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুইটি দুর্নীতি মামলার সাজা মওকুফ করলেও আদালতের মাধ্যমে এসব মামলা নিষ্পত্তি চান খালেদা জিয়া। অতঃপর ২৭ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে তিনি এসব দুর্নীতি মামলা থেকে খালাস পান।

২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে বেকসুর খালাস দিয়ে রায় ঘোষণার সময় আপিল বিভাগ বলেন,প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এ মামলা করা হয়েছিল। মামলার বিচার ছিল সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে সামাজিকভাবে অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়