মহসিন কবির: লন্ডন বৈঠকের পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিদেশিরা নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এ আশাব্যক্ত করেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করে। চীন সরকার বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে অপেক্ষায় আছে।
তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কৃষি, শিল্প, গার্মেন্টস, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের সহায়তা অব্যাহত রাখা।বাণিজ্য অসমতা দূরীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণসহ আধুনিক প্রযুক্তি, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশও বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নজরও নির্বাচনকেন্দ্রিক। তাঁরা সরকারের উপদেষ্টা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে জানার-বোঝার চেষ্টা করছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকার আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও বিএনপিসহ কয়েকটি দল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানায়। নির্বাচনের সময় নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকাশ্য হয়।
পরে লন্ডনে ১৩ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একান্ত বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে শর্ত সাপেক্ষে আগামী বছর পবিত্র রমজান মাসের আগে (ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ) জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা জানানো হয়। এর পর থেকে আলোচনা হয়ে উঠেছে নির্বাচনকেন্দ্রিক। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ তাদের ঢাকার মিশনের মাধ্যমে পরিস্থিতির খোঁজখবর নিচ্ছে।
বিদেশি কূটনীতিকেরা আগামী নির্বাচনের সময়, ভোট এবং ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের ধরন ও নীতি জানতে- বুঝতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। কিছু দেশ ও সংস্থা শুধু স্থানীয় মিশনের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে পরিস্থিতি আগাম ও ঠিকঠাক বুঝতে আগে ঢাকায় কাজ করে যাওয়া ব্যক্তিদের পাঠাচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদেশিরা বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা, বাস্তবমুখী নীতি ও তার ধারাবাহিকতা চান। তাই তাঁরা আগামী সরকার নির্বাচনের ওই ভোট কেমন হতে পারে, তা বুঝতে চাইছেন। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ বছর প্রায় সব পর্যায়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ব্যাপক প্রভাব ছিল। বর্তমানে ভারতবিরোধী প্রচার থাকায় নির্বাচনের পর সম্ভাব্য নতুন সরকারের বিদেশনীতি কী হতে পারে, তার ধারণা পাওয়ারও চেষ্টা করছেন বিদেশি কূটনীতিকেরা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিদেশিদের অনেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কথা বলছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, নির্বাচন কখন কীভাবে হতে পারে, তা সবাই বুঝতে চায়।’ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, চীনসহ সবার ভাবনা প্রায় একই রকম। চিন্তার ধরনে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও ভারতও এদের সঙ্গে আছে।
চীন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে বেইজিং ও কুনমিংয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতাদের বৈঠকের আয়োজন করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যসহ একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে রয়েছে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিক আলাপকালে বলেন, লন্ডন বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে শর্ত সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনের আভাস পাওয়া গেছে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে নির্বাচনের সময় নিয়ে মতভেদ দেখা যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন থেকে ফেরার পর এনসিপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপের উল্লেখ করে একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত বলেন, উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা দেখছেন না। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে আলাপেও তিনি একই ইঙ্গিত দেন।
সরকারের ভেতরের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার বিষয়ে একাধিক নারী উপদেষ্টাসহ অন্তত পাঁচজন উপদেষ্টা ভিন্নমত পোষণ করেন। দুজন মনে করেন, আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন না করলেও তেমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হওয়ার কথা নয়।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও আগে স্থানীয় নির্বাচনের বিষয়ে আগ্রহ ফেসবুক পোস্টে বলেছেন। এ অবস্থায় আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, সেটাও বুঝতে চান বিদেশিরা।
ব্যাংকিংয়ের জন্য সুপরিচিত একটি দেশের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি নিজ বাসভবনে এক আড্ডায় প্রশ্ন তোলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ একটি বড় দল, কোটি কোটি সমর্থক-ভোটার আছেন। দুর্নীতি ও হত্যার অভিযোগে দলটির কিছু নেতার সাজা ও তাঁরা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। কিন্তু দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলে ‘নির্দোষ’ নেতাদের কি প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ও ব্যালট পেপারে ‘নৌকা’ প্রতীক থাকবে? তিনি বলেন, ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলতে যদি কোনো দলের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকা না থাকা না বোঝায়, তাহলে দলটির কোটি কোটি সমর্থকের মতামত এই নির্বাচনে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে?
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক ১৬ জুন জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন, ‘রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে সম্প্রতি আইনে পরিবর্তন আনা এবং এ-সংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ডে আমি উদ্বিগ্ন। এটা অন্যায্যভাবে সংগঠনের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সমবেত হওয়ার স্বাধীনতাকে সীমিত করবে।’ অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে অগ্রগতি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি সংস্কারের ক্ষেত্রে অর্থবহ অগ্রগতির আহ্বান জানান, যাতে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা যায়।
পূর্ব এশিয়ার একটি প্রভাবশালী দেশের হয়ে ছয় বছর আগে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া এক কূটনীতিক গত সপ্তাহে নীরবে ঢাকা সফর করেন। তিন দিনের ওই সফরে তিনি রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা, গবেষক ও গণমাধ্যমে কর্মরত অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর প্রশ্ন, এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণার সাত দিনের মধ্যে কেন ফেব্রুয়ারিতে সময় ঘোষণা করা হলো? ভারতে অবস্থান করা শেখ হাসিনার কোনো প্রভাব কি আগামী নির্বাচনে থাকবে?
ওই কূটনীতিকের দেশ থেকে বাংলাদেশে অবকাঠামো ও শিল্প খাতে ভালো বিনিয়োগ আসে। নিজ দেশের ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীলতা দরকার। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার আসার আগপর্যন্ত অনেকে নতুন বিনিয়োগে রাজি হচ্ছে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহের বিষয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী গতকাল বলেন, সব নির্বাচনেই বিদেশিদের কমবেশি আগ্রহ থাকে। তবে এবার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। গত ১৫ বছর অনেক দলের সঙ্গে বিদেশিদের যোগাযোগ কম ছিল। এখন ভবিষ্যতে যাঁরা সংসদে যাবেন, সরকার চালাবেন, তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব কমানো ও সহজীকরণের অংশ হিসেবে বিদেশিরা যোগাযোগ বাড়িয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যাতে একমত পোষণ করেছে জামায়াত। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার বিরতিতে জামায়াতে ইসলামীর এই অবস্থান তুলে ধরেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, ইলেক্টোরাল কলেজে ইউপি মেম্বার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার জনপ্রতিনিধি ভোটার হিসেবে থাকবেন। অন্যদিকে গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে কয়েকটি দল। জামায়াতে ইসলামী এই প্রস্তাবকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে বলে জানায় আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ সব নির্বাচন গোপন ব্যালটে হয়। তাই তাঁর দল এমন প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানায়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কয়েকটি মতামত তুলে ধরেছে। সংসদ যদি উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে বিভক্ত হয়, তাহলে ৫০০ ইলেকটোরাল কলেজ। আরেকটি প্রস্তাব হলো, উচ্চ-কক্ষ ও নিম্নকক্ষের সদস্যদের পাশাপাশি জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে ৫৭৬ ইলেকটোরাল কলেজে উন্নীত করা। তৃতীয় মতটি হলো ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব।
দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ নিবন্ধন ফিরে পেল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। মঙ্গলবার (২৪ জুন) নির্বাচন কমিশন থেকে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামীয় দলের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন দলীয় প্রতীকসহ পুনর্বহাল করা হলো।
এর আগে গত ৪ জুন দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লার’ সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফেরত দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ইসি।