শিরোনাম
◈ আমরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়েছি: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ◈ এরশাদের বউ বিদিশার গাড়ি রং সাইডে, ভিডিও ভাইরাল! ◈ উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মাথায় বোতল নিক্ষেপ করলেন যে ব্যক্তি (ভিডিও) ◈ উপদেষ্টা মাহফুজের সঙ্গে যা হয়েছে, এর জন্য আপনাদের প্রতি ধিক্কার : সারজিস আলম ◈ উপদেষ্টা মাহফুজকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়: হাসনাত আবদুল্লাহ ◈ শিক্ষার্থীদের দাবিতে দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস, আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনের অভিযোগ মাহফুজ আলমের ◈ এবার চীনের সঙ্গে বিরোধে জড়াল ভারত! ◈ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ভারতের অর্থমন্ত্রীকে বিকল্প খোঁজার পরামর্শ ◈ পুলিশ হেফাজত থেকে পালালেন ছাত্রলীগ নেতা, ৪ পুলিশ ক্লোজড ◈ উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মাথায় বোতল নিক্ষেপ (ভিডিও)

প্রকাশিত : ১৪ মে, ২০২৫, ০৭:৫০ বিকাল
আপডেট : ১৫ মে, ২০২৫, ০২:০০ রাত

প্রতিবেদক : মনজুর এ আজিজ

নানা বৈষম্যে চাকরি ছাড়ছেন পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা!

মনজুর এ আজিজ : সরকারি চাকরি সোনার হরিণ বলে খ্যাত হলেও পেট্রোবাংলায় কেউ চাকরি করতে চাচ্ছেন না। টেকনিক্যাল লোকদের উপরে নন টেকনিক্যাল লোক বসানো, নানা রকম রাজনৈতিক চাপ, অনৈতিক নির্দেশনা ও বেতন-ভাতা বৈষম্যের কারণে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই চাকরি ছেড়ে বিভিন্ন যায়গায় চলে গেছেন। শূন্যপদে অনেককে নিয়োগ দেয়া হলেও দেখা যাচ্ছে প্রথম বছরেই ৩০ শতাংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আবার এ প্রতিষ্ঠানে দশ-পনের বছর চাকরি করেও অনেকে এখন চলে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন বলে জানা গেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) ৬৫২ পদের বিপরীতে লোকবল রয়েছে মাত্র ২৮৮ জন, মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী শুন্যপদের সংখ্যা রয়েছে ৩৬৪টি। ২০১২ সালের একটি ব্যাচে ১২ জনকে নিয়োগ করা হলেও ওই ব্যাচের ৯ জনই চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। অবশিষ্ট ৩ জনের ২ জন চাকরি ছাড়ার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। পেট্রোবাংলার অধীনস্থ কোম্পানিগুলোর অবস্থা আরও করুন। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৭০ শতাংশ পদ শূন্য পড়ে রয়েছে। বিতরণ কোম্পানিটির অনুমোদিত পদ (কর্মকর্তা) ৪৫০ জনের মধ্যে রয়েছেন ২৫৭ জন, আর ৬৫৬ কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১৫৬ জন। অর্থাৎ কর্মচারী পদে ৫০০টি পদই শূন্য পড়ে রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য কোম্পানির শূন্যপদ এখন প্রায় ৫০ শতাংশের উপরে।

পেট্রোবাংলায় লোকবল কেনো থাকছে না সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মোটাদাগে কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে। তারমধ্যে রয়েছে- টেকনিক্যাল লোকদের উপরে নন টেকনিক্যাল লোক বসানো, নানা রকম রাজনৈতিক চাপ, অনৈতিক নির্দেশনা ও বেতন-ভাতা বৈষম্য। সম্প্রতি পেট্রোবাংলার কার লোন সুবিধা বাতিল করায় কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ আরও বেড়ে চাকরি ছাড়ার বিষয়টি মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

জানা যায়, একই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ম করপোরেশের অধীনস্থ কোম্পানি, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ও যমুনা অয়েল কোম্পানি নানা সুবিধা পেলেও পেট্রোবাংলা ও তার অধীনস্থ কোম্পানিগুলো সেসব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আবার পেট্রোবাংলার অধীনস্থ কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের বৈষম্যও অনেককে বিমুখ করে তুলছে।

সম্প্রতি বাপেক্স ছেড়ে কয়েকজন যোগদান করেছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগে। তারা মাঠ পর্যায়ে কাজে দারুণ সুনাম অর্জন করেছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, আমি বাপেক্সে ছিলাম ষষ্ঠ গ্রেডে, সেখান থেকে সিভিল সার্ভিসের নবম গ্রেডে যোগদান করেছি। কতটা হতাশ হলে মানুষ ডাউন গ্রেডে যোগদান করে!

ঠিক কি কারণে বাপেক্স ছাড়লেন! জবাবে বলেন, আমরা প্রকৌশলীরা যারা ৫ থেকে ৭ বছর ফিল্ডে কাজ করি, তাদের কোন মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে না। বোর্ড অথবা মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমরা হতাশ হই সিনিয়রদের দেখে, প্রচণ্ড রকম হতাশ ছিলেন অনেকে। রুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন, রুয়েটে চাকরি ছেড়ে বাপেক্সে যোগদান করেন। তিনি যখন বলেন, আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই, তাদের কথাই শেষ কথা, তারা না জেনেও সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছেন। মিড লেভেলে চলে এসেছি, যা বলছে তাই করতে হচ্ছে। তাদের অনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। কাগজে কলমে দায়ও নিতে হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যোগদান করার পর অনেকেই পেট্রোবাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ৩০ শতাংশই চলে যাচ্ছে এক বছরের মধ্যে। এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশ, পররাষ্ট্র ক্যাডারে চলে যাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। সম্প্রতি একটি নিয়োগ চূড়ান্ত করার পর পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম পূরণ করতে বলা হলে ২৭ জন প্রার্থী বিরত থেকেছে।

শ্রীকাইল-৪ নম্বর কূপের ডিপিপির দিকে তাকালে অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়। ২০১৪ সালে কূপটির জন্য ডিপিপি প্রণয়নের তোড়জোড় শুরু হয়। বাপেক্স বোর্ড ৩৫৪তম সভায় অনুমোদন দেন শ্রীকাইল ৪ নম্বর কূপ খননের। ডিপিপিতে (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) ব্যয় ধরা হয় ৬৪ কোটি টাকা। ৫৫৬তম বোর্ড সভায় ডিপিপি অনুমোদন দেয় বাপেক্স। অনুমোদিত ডিপিপি পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করা হয়। পেট্রোবাংলা অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ শুরু করার কথা, কিন্তু পেট্রোবাংলায় প্রস্তাব যাওয়ার পর সবকিছু থেকে যায়। নির্দেশ দেওয়া হয় ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি করতে। বাপেক্স সে অনুযায়ী ডিপিপি প্রণয়ন করে, আর কাজটি দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। তখন তৌফিক-ই- ইলাহী চৌধুরীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এ রকম অনেক অনৈতিক কাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও করতে হয় এখানে। যে কারণে সৎ অফিসাররা চাকরি ছেড়ে চলে যেতে থাকেন।

বাপেক্স ছেড়ে যাওয়া আরেক কর্মকর্তা বলেন, নিজের থেকে যখন কম দক্ষ লোকদের দ্বারা পরিচালিত হতে হয় তখন কষ্টটা বেড়ে যায়। ড্রিলিংয়ে কাজ করছে অথচ ড্রিল পাইপ, গ্যাস কি সেটাই জানেন না, তিনি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন।
পঞ্চাশ শতাংশের উপর শূন্য রয়েছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি (বিসিএমসিএল) বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফসিএল), সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি (এসজিসিএল), কর্নফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে। তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা বাপেক্সের ১০৮০ পদের মধ্যে ৩৯৬ পদ শূন্য। পেট্রোবাংলা ও তার অধীনস্থ কোম্পানিগুলোতে মোট পদশুন্য রয়েছে ৬ হাজার ৬৩৮টি।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, পেট্রোবাংলায় ৩টি ক্যাডার অর্থ, কারিগরি ও প্রশাসন বিদ্যমান। আর এন্ট্রি পদ হচ্ছে সহকারী ব্যবস্থাপক (নবম গ্রেড) এবং সহকারী কর্মকর্তা (দশম গ্রেড)। নবম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে দশম গ্রেড থেকে প্রমোশনের মাধ্যমে ৩৩ শতাংশ নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখানে নবম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ প্রমোশনের বিষয়টি অনেক সময় জটিলতা দেখা দেয়। দেখা যায়, পদ শূন্য কিন্তু ফিডার পদে ৩ বছরের অভিজ্ঞ প্রার্থী নেই। সে কারণে পদ শূন্য থেকে যায়।

জ্বালানির তুলনায় আড়াইগুণ বেশি বেতন দিচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলো। বাপেক্সে উপ-ব্যবস্থাপক (গ্রেড-৬) বেসিক ৩৭৫০০ একই সময়ে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিতে বেসিক ছিল ৭১০০০ টাকা। এন্ট্রি পদ নবম গ্রেডে বাপেক্সে ২২ হাজার আর নর্থওয়েস্টে ৫২ হাজার টাকা। এটাও কোন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।

দেশের জ্বালানির খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। তাদের উপর নির্ভর করছে, দেশের তেল-গ্যাস কয়লারসহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদ পাওয়া না পাওয়া। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা তাদের। অথচ নানা অজুহাতে সব সময় বিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর প্রসঙ্গে এলে বলা হয়, ভর্তুকির কথা। অথচ জ্বালানির চেয়ে সব সময় ৫ থেকে ৭ গুণ বেশি ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুতে। সমন্বয়হীনতার কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে কিন্তু গ্যাসের অভাবে বসে থাকছে বছরের পর বছর। তবুও অবহেলিত গ্যাস খাত।

দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি খাতকে অবহেলার মাধ্যমে ন্যুব্জ করে রাখা হয়েছে। ব্যাপক তেল-গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলেও সেভাবে এইখাতকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় প্রতি বছর ৪টি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোন সরকারই তা মেনে চলেনি। আবিষ্কারের হার উচ্চ হলেও মনোযোগ পেতে ব্যর্থ এই খাত। কয়েক দশকের পুঞ্জীভূত অবহেলার ফলে ভয়াবহ গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে।

নন টেকনিক্যাল লোকজনকে টেকনিক্যাল লোকের উপর বসানো প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ১৩টি কোম্পানির মধ্যে ১২ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশল জ্ঞান সম্পন্ন। এমডি টেকনিক্যাল পার্সন হলেও তিনি একা বোর্ডে। ননটেকনিক্যাল লোকজনের আধিক্য, সেখানে সিদ্ধান্ত বদলে যাচ্ছে! এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, বোর্ডের বিষয়ে আমার কোন করণীয় নেই। এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার যেখানে সুযোগ রয়েছে, সেখানে টেকনিক্যাল লোকজনদের দিয়েছি।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, সুযোগ সুবিধা বেশি হওয়ায় অনেকেই বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোতে চলে যাচ্ছে। পেট্রোবাংলা চলে জাতীয় পে-স্কেল নীতিমালায়, আর বিদ্যুতের কোম্পানিগুলো নিজস্ব বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করে। তিনি বলেন, পেট্রোবাংলা ও অধীনস্থ কোম্পানিগুলোর শুন্যপদে ৭৬৮ জন অফিসার ও ২০০ জন কর্মচারী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা নিয়োগের পরেই বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেখানে জ্বালানি খাতের সম্ভাবনা তুলে ধরা হবে। আমার ধারণা এটি করা গেলে ছেড়ে যাওয়ার হার কমে আসবে।

এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খাদের কিনারে রয়েছে দেশের গ্যাস সেক্টর, সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে ২০২৬ ও ২০২৭ সাল নাগাদ মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা দেখছেন অনেকেই। সেই শঙ্কা দূর করতে যাদের রাতদিন কাজ করার কথা, সেই পদগুলোই পড়ে রয়েছে শূন্য। অন্যান্য সেক্টরে সংস্কারের উদ্যোগ দেখা গেলেও এই সেক্টরের বিষয়ে এখনও কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এখন থেকে এ সেক্টরে মনোযোগ না দিলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে গ্যাস সঙ্কটে পড়বে দেশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়