মানুষের দেহ যেমন খাদ্যের দ্বারা বাঁচে, তেমনি তার আত্মা বাঁচে ঈমান ও সুন্নাহর বরকতে। রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধু ইহজাগতিক চিকিৎসাই শেখাননি, বরং এমন আমল ও আহার শিক্ষা দিয়েছেন, যা দেহ ও আত্মা উভয়কেই সুরক্ষিত রাখে। তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাণী যুগে যুগে মানবতার জন্য আলোকবর্তিকা। এমনই এক আলোকবর্তিকার হাদিস হলো—
عَنْ سَعْدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ تَصَبَّحَ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعَ تَمَرَاتٍ عَجْوَةً لَمْ يَضُرَّه“ فِي ذلِكَ الْيَوْمِ سُمٌّ وَلاَ سِحْرٌ.
সা’দ তাঁর পিতা হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেকদিন সকালবেলায় সাতটি উৎকৃষ্ট আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন তার উপর কোনো বিষ ও যাদু প্রভাব ফেলবে না।(বুখারি, হাদিস : ৫৪৪৫)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
‘আজওয়া’ (عَجْوَة) হলো মদিনা মুনাওয়ারার এক বিশেষ প্রজাতির খেজুর। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে এই খেজুরের চাষ করেছিলেন এবং এর বিশেষ গুণের কথা বলেছেন।
এই হাদিসের অর্থ হলো— আল্লাহর কুদরতে বিশেষভাবে বরকতময় এই খেজুরে এমন প্রাকৃতিক প্রতিষেধক (antidote) রয়েছে, যা আল্লাহর ইচ্ছায় বিষ ও যাদুর ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
এটি শুধু বস্তুগত নয়; বরং এর সঙ্গে রয়েছে তাওহীদের আশ্রয় ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে আমল করার আধ্যাত্মিক বরকত।
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ব্যাখ্যাকারদের ভাষ্য
ইবনু হজর আল-আসকালানী (রহ.) বলেন, ‘এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, ‘আজওয়া’ খেজুরে আল্লাহ তাআলা বিশেষ প্রতিষেধক গুণ রেখেছেন, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মের বাইরে। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মু‘জিযার অংশ।’ (ফাতহুল বারী, ১০/২৩৯) অর্থাৎ, এটি কেবল একটি চিকিৎসা নয়; বরং নবুয়তী বরকতের সঙ্গে যুক্ত একটি আধ্যাত্মিক সুরক্ষা।
ইমাম আন-নববী (রহ.) বলেন, ‘আজওয়া’ খেজুর মদিনার এক বিশেষ প্রজাতি। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উক্তি কেবল এই প্রজাতির জন্য, সব খেজুরের জন্য নয়। তবে এতে শিক্ষা হলো, খাদ্যের মধ্যে আল্লাহ বরকত রাখেন এবং হালাল খাদ্য আত্মার সুরক্ষার মাধ্যম।’ ( শরহু সহিহিল মুসলিম, ১৪/৩) অর্থাৎ, এটি নিছক ‘খাদ্য’ নয়; বরং ঈমান, নিয়্যত ও বরকতের বিষয়।
ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, ‘এই হাদিসের অর্থ এমন নয় যে আজওয়া খেলে যাদু ও বিষ কখনোই ক্ষতি করতে পারবে না; বরং এর অর্থ হলো, আল্লাহর হেফাযতে সে ব্যক্তি নিরাপদ থাকবে, যেমন কেউ ওষুধ খেলে আল্লাহর অনুমতিতে আরোগ্য লাভ করে।
’আলজামিউ লিআহকামিল কোরআন, ১/৩৬২) অর্থাৎ, প্রতিরোধের কারণ হিসেবে আজওয়া গ্রহণ করা এক প্রকার তাওয়াক্কুলের অংশ।
ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রহ. বলেন, ‘আজওয়া খেজুর মদীনার ফলগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম। এতে এমন ওষুধি গুণ আছে যা হৃদয় ও শরীর উভয়কে প্রভাবিত করে। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বাণী অনুযায়ী, এটি যাদু ও বিষের প্রতিষেধক।’ (যাদুল মা‘য়াদ, ৪/৯০) তিনি এটিকে তিব্বে নববী (Prophetic Medicine)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ
গবেষণায় দেখা গিয়েছে- ‘আজওয়া’ খেজুরে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পলিফেনলস, ফ্ল্যাভোনয়েডস ইত্যাদি উপাদান, যা বিষক্রিয়া প্রতিরোধ ও যকৃত সুরক্ষা দেয়। এতে থাকা প্রাকৃতিক গ্লুকোজ, খনিজ ও ভিটামিন শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মদিনার মাটির বিশেষ উপাদানও (trace minerals) এই খেজুরের অনন্য গুণের উৎস বলে ধারণা করা হয়।
অতএব, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই বাণী চিকিৎসা, আধ্যাত্মিকতা ও ঈমান; তিন ক্ষেত্রেই সত্যপ্রমাণিত।
‘আজওয়া খেজুর’ শুধু এক প্রকার ফল নয়; এটি নবুয়তের এক অলৌকিক নিদর্শন। যে হৃদয়ে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর প্রতি আস্থা আছে, তার জন্য এই ছোট ফল হয়ে ওঠে বিষ, যাদু ও ভয়; সব কিছুর বিরুদ্ধে এক বরকতময় ঢাল।
সূত্র: কালের কণ্ঠ