তেহরানে চলমান ইসরায়েলি বোমা হামলার আতঙ্কে তুরস্ক সীমান্তের কাপিকয় ক্রসিংয়ে ভিড় করছেন ইরান থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকরা। যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম দিকে কেউ কেউ ভেবেছিলেন, এটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তেহরানবাসীদের চোখেমুখে আতঙ্ক, দিশেহারা জনজীবন। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
প্যারিসপ্রবাসী ৫৮ বছর বয়সী ইরানি-মার্কিনি মেহরান আতাই বলেছেন, প্রথম দুই দিন সবাই বলছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর যা হলো, তা আতঙ্কের। বোমা পড়ছে, ধোঁয়া উড়ছে, আমরা জানিই না কখন কোথা থেকে মৃত্যু নেমে আসবে।
তেহরানে যুদ্ধ শুরুর পাঁচ দিন পর স্ত্রীসহ পালিয়ে আসেন আতাই। তুর্কি সীমান্তে তিনি জানান, ইন্টারনেট ছিল প্রায় অচল, দুটি বড় ব্যাংকে সাইবার হামলার ফলে টাকা তোলাও অসম্ভব হয়ে পড়ে, আর খাবার তো ছিল না বললেই চলে।
তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ২৭ বছর বয়সী মেয়ে লিদা পুরমোমেন। তিনি জানালেন, আমরা একসঙ্গে বের হতে পারিনি। মঙ্গলবার রাতটা ছিল তেহরানের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মনে হচ্ছিল যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে। মনে হয়েছিল, হয়তো আর কোনোদিন মায়ের মুখ দেখতে পারবো না।
তেহরান থেকে প্যারিস ফেরার কথা ছিল শনিবার। কিন্তু সব ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় তারা সেখানে আটকা পড়েন। ফরাসি দূতাবাসে বারবার ফোন করে সাহায্য চান। সোমবার তাদের সঙ্গে দূতাবাসের যোগাযোগ হয়। কিন্তু আপাতত তাদের তেহরানেই থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
লিদা বলেন, কিন্তু মঙ্গলবার এক ইমেইলে জানানো হয়, ফরাসি নাগরিকদের ইরান ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে তখন ইন্টারনেট ছিল মাত্র দুই-তিন ঘণ্টার জন্য, তাই অনেকেই হয়তো সেই ইমেইল পাননি।
আতাই বলেন, আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো আর কখনও বের হতে পারতাম না।
বৃহস্পতিবার সকালে সীমান্তে অন্তত কয়েক ডজন ইরানির আগমন দেখে গেছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, পালিয়ে আসার সংখ্যায় এখনও বড় কোনও পরিবর্তন হয়নি।
মেলবোর্নপ্রবাসী ৫০ বছর বয়সী এক ইরানি নারী ফার্মাসিস্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মায়ের চিকিৎসার জন্য তিনি তেহরানে গিয়েছিলেন যুদ্ধ শুরুর দিনেই। পাঁচ দিন পর সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন। তিনি বলেন, প্রথমে কিছু বোমা পড়ছিল, কিন্তু তারপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গতকাল ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়, দুটো বড় ব্যাংক হ্যাক হয়, ফলে কেউ টাকাই তুলতে পারছিল না। খাবারও ছিল না।
তিনি জানান, অনেকে উত্তরাঞ্চলের দিকে যাচ্ছেন। কারণ ওই দিক সামান্য ভালো, তবে একেবারে নিরাপদ নয়। তার কথায়, আমরা আগেও যুদ্ধ দেখেছি। কিন্তু এটি সবচেয়ে খারাপ। কারণ এবার আগাম বোঝা যাচ্ছে না কোথায় বোমা পড়বে, আর খুবই বর্বর।
তেহরানের এই দুঃসময়েও অনেকে বিশ্বাস করেন, ইরানিরাই কেবল নিজেদের ভাগ্য বদলাতে পারে। তবে তেহরান থেকে পালানো এই ফার্মাসিস্ট বলেন, মানুষ চায় পরিবর্তন, কিন্তু তারা পারছে না। কারণ সবাই আতঙ্কে আর এই শাসকগোষ্ঠী ভয়াবহ রকমের নিষ্ঠুর।
যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধে নাকি কেবল কথা বলছে, তা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা জানি খামেনিই সমস্যার মূল। ট্রাম্প বলেন, ‘আমি তাকে হত্যা করতে চাই না।’ আপনি যদি সত্যিই যুদ্ধ থামাতে চান, তাহলে এমন কথা বলেন কেন? ট্রাম্প কেবল যুদ্ধ থামানোর অভিনয় করছেন। এই স্বৈরাচারী সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রই টিকিয়ে রেখেছে।
৬৯ বছর বয়সী লন্ডনপ্রবাসী ইসমাইল রাবিই বলেন, পরিবর্তন আসবে কি না, তা নির্ভর করে আমেরিকা বা ইউরোপের ওপর। ওরা চাইলে পরিবর্তন হবে, না চাইলে হবে না।
তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে জানান, দেশটা এমন এক যুদ্ধে জড়িয়েছে, যেখানে জনগণের কণ্ঠ রুদ্ধ, খাবার নেই, নিরাপত্তা নেই, আশাও নেই।