মহসিন কবির: বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা প্রবাসী এবং দেশের অভ্যন্তরে আইনি হেফাজতে থাকা কারাবন্দি ভোটারদের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করতে চ্যালেঞ্জে ইসি। চ্যালেঞ্জে হলেও ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিতে কাজ করছে কমিশন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসী এবং কারাবন্দিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত, আইনগত ও বাস্তবায়নগত দিক থেকে অনেক জটিলতা রয়েছে। ইসিকে এসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।
বিদেশে থাকেন বাংলাদেশের এমন নাগরিকদের জন্য ডাকযোগে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থার কথা আইনে ৫৩ বছর ধরে আছে। কিন্তু কোনো নির্বাচনে প্রবাসীরা ভোট দিতে পারেননি। নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ডাকযোগে প্রবাসীদের ভোট নেওয়ার কথা বলছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো এ বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার শুরু করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারও প্রবাসীদের ভোট নেওয়ার প্রক্রিয়াটি ঠিক সহজ নয়। এতে নিবন্ধন, যাচাই-বাছাই, ডাকযোগে ব্যালট পেপার পাঠানো এবং ভোট দিয়ে ব্যালট পেপারটি আবার ডাকযোগে দেশে ফেরত পাঠানোসহ প্রতিটি ধাপেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন অবশ্য প্রবাসী ভোটের এ চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকার কথা বলছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘প্রবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণই এ উদ্যোগ সফল করবে এবং এটি আমাদের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।’ ইউটিউব চ্যানেলে প্রবাসীদের উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা বলেন।
নির্বাচন কমিশন বলছে, ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ মোবাইল অ্যাপ গুগল প্লে স্টোর ও অ্যাপল স্টোর থেকে ডাউনলোড করা যাবে। এতে নির্দেশনামূলক ভিডিও থাকবে, যেখানে ধাপে ধাপে নিবন্ধনের নিয়ম বোঝানো হবে। নিবন্ধনের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের তথ্য ও প্রবাসের ঠিকানা দিতে হবে। এ ছাড়া ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করতে ‘ফেস আইডেন্টিফিকেশন’ ও মানবসত্তা নিশ্চিত করতে ‘লাইভনেস ডিটেকশন’ সম্পন্ন করতে হবে। নিবন্ধন শেষে প্রবাসীর ঠিকানায় ব্যালট পেপার ও ফেরত খাম পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ভোট দিয়ে খামে পুরে ব্যালট পেপারটি ডাকযোগে ফেরত পাঠালেই তা নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন কমিশনে পৌঁছাবে।
কমিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে বাস করছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক ৭৯ লাখ মধ্যপ্রাচ্যে, উত্তর আমেরিকায় ১৩ লাখ ৮২ হাজার, ইউরোপে ১৮ লাখ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৭ লাখ এবং অন্য অঞ্চলে কয়েক লাখ বাংলাদেশি আছেন।
১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২৭(১) ধারায় বিদেশে বসবাসরত নাগরিকদের ডাকযোগে ভোট প্রদানের অধিকার দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সময় বিষয়টি কিছুটা আলোচনায় আসে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রবাসীরা ভোট দিতে পারেননি।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন আয়োজিত সংলাপে প্রবাসীদের জন্য তিনটি পদ্ধতির কথা আলোচনায় আসে। অনলাইনে ভোট ‘সম্ভব নয়’ এমন বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলো ‘প্রক্সি ভোট’ সমর্থন না করায় তাও বাদ দেওয়া হয়। সবশেষে ব্যালট পদ্ধতিতে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন ফেসবুকে ভেরিফায়েড পেজে গত ২৩ সেপ্টেম্বর জানায়, আগামী ১ নভেম্বর অ্যাপটি চালু করা হবে। অ্যাপে লগইন করে প্রবাসীদের দুটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। একটি হচ্ছে ‘এনরোলমেন্ট প্রসেস,’ অন্যটি ‘ভোটিং প্রসেস’। রাসেল আহমেদ নামে একজন ফেসবুকে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এত জটিল পদ্ধতিতে কে ভোট দেবে।’ হাদি আল-ফারহান নামে এক ব্যক্তি প্রক্রিয়াটি সহজ করার দাবি জানান।
এর আগে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, এবার প্রবাসী ভোটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ব্যালট পৌঁছানো ও ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা। তিনি বলেন, ‘আদালতের আদেশে প্রার্থী তালিকা পরিবর্তন হলে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ভোট বাতিল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও আছে।’
সানাউল্লাহ বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালটে নিবন্ধনের হার মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে ভোট সংগ্রহের হার ৩০ শতাংশের নিচে।
অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পর প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ বাস্তবায়নের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতারা। তাদের প্রত্যাশা, এ পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বকে শক্তিশালী করবে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কমিশন প্রবাসীদের ভোটগ্রহণে যে পদ্ধতি নিয়েছে, তা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করলে বোঝা যেত, কতখানি ভোটগ্রহণ সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যালট যদি প্রবাসী ভোটারদের হাতে সঠিক সময়ে পৌঁছানো যায়, তাহলে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর ভোট সংগ্রহ করা সহজ হবে। তখন বোঝা যাবে এ পদ্ধতি কতখানি কার্যকর।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় প্রবাসীদের ভোটার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা অনেকটা জটিল। প্রবাসীদের অনেকে এসব প্রক্রিয়ায় কতটা সফল হবেন, তা বোঝা মুশকিল।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমবার চেষ্টা করছে। আমরা অপেক্ষা করব দেখার জন্য।’
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যে অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটার করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে অ্যাপে সব প্রবাসী সহজে ভোটার হতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, ধীরে ধীরে প্রবাসীরা এতে অভ্যস্ত হবেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনসহ যারা এটা পরিচালনা করবেন, তাদের নৈতিকতা ও সততার ওপর এর ফল নির্ভর করবে।’