শিরোনাম
◈ কিস্তি দিতে না পারায় গৃহবধূর আংটি ও বদনা নিয়ে গেলো এনজিও! ◈ ডরি ফিসের নামে কী খাচ্ছেন? বাজারে 'ডরি ফিস' খুঁজতে গিয়ে সামনে এলো ভয়ংকর তথ্য!(ভিডিও) ◈ বাংলা‌দেশ জিত‌লো তামিমের সেঞ্চুরিতে, সি‌রিজ শেষ হ‌লো সমতায়  ◈ তোপের মুখে হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় ছাত্রলীগ কর্মীকে ছেড়ে দিল পুলিশ (ভিডিও) ◈ ‘ফজু পাগলা’ উপাধি যারা দিয়েছে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই: ফজলুর রহমান ◈ সরকার থেকে পদত্যাগ নিয়ে যা বললেন আসিফ মাহমুদ ◈ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাতিল হবে ৬ ধরনের দলিল: আসছে সম্পূর্ণ ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থা ◈ আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক: সিইসি নাসির উদ্দিন ◈ 'র' এর মাধ্যমে শিখ নেতাদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অমিত শাহ, চাঞ্চল্যকর তথ্যচিত্র প্রকাশ! (ভিডিও) ◈ জেট ফুয়েলের দাম আরও বাড়ল, বিমান ভাড়া কি বাড়বে?

প্রকাশিত : ০৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:০৭ বিকাল
আপডেট : ০৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৯:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এক দশক পুরনো টেলিকম অডিট বিরোধের সালিশি মাধ্যমে সমাধানের প্রস্তাব গ্রামীণফোনসহ শীর্ষ অপারেটরদের

গ্রামীণফোনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটররা — টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসির কাছে তাদের দীর্ঘমেয়াদি অডিট বিরোধ সালিশির মাধ্যমে নিষ্পত্তির আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে। বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন এই প্রক্রিয়াকে সামনে এনে, তারা ইঙ্গিত দিয়েছে এবার এক দশকের পুরনো কর্পোরেট-বিতর্কের একটি সমাধান হতে পারে।

প্রথমবারের মতো সরকার ও বিটিআরসি উভয়ই এই প্রস্তাবে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিটিআরসির সিনিয়র কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির বিষয়টি এখন সক্রিয়ভাবে বিবেচনাধীন — যা প্রায় এক দশকের আইনি স্থবিরতার পর পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানের আশা জাগাচ্ছে।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "এই অচলাবস্থা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট শিল্প—কারো জন্যই লাভজনক নয়। আমরাও সমাধান চাই। আদালতের বাইরে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যায় কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি—আমাদের প্যানেল আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছি এবং অভ্যন্তরীণ বিকল্পও যাচাই করছি।"

ইতোমধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা শুরু হয়েছে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

রবি ও বাংলালিংক — যাদের বিরুদ্ধেও একই রকম কিন্তু তুলনামূলক ছোট আকারের অডিট দাবি রয়েছে — ঘনিষ্ঠভাবে ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ, এই প্রক্রিয়া টেলিকম খাতের বড় ধরনের বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

এক দশকের পুরনো দ্বন্দ্ব

এই বিরোধের সূত্রপাত ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ের বিটিআরসির বিস্তৃত অডিট থেকে, যা আইন অনুযায়ী বার্ষিক অডিট না করে ২০১৭ সালে একযোগে শুরু হয়। ২০১৯ সালে সংস্থাটি বকেয়া ফি, রাজস্ব শেয়ার ও সুদের ভিত্তিতে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা, রবির বিরুদ্ধে ৮৬৭ কোটি টাকা এবং বাংলালিংকের বিরুদ্ধে প্রায় ৮২৩ কোটি টাকার দাবি উত্থাপন করে।

মোবাইল অপারেটররা বরাবরই এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করে — যুক্তি দেখিয়েছে যে, অডিটের পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ, কর্তৃত্ব সীমার বাইরে, এবং সুদের হিসাব অযৌক্তিকভাবে বেশি। তবে বিটিআরসি বলছে, এই টাকাগুলো সরকারের রাজস্ব, সুতরাং সেটা সরকারকে ফেরত দেওয়াই ন্যায্য।

সালিশির পথে অপারেটররা

২০২৫ সালের ২৯ জুলাই গ্রামীণফোন আনুষ্ঠানিকভাবে বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কাছে  প্রস্তাব দেয়, একটি বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন 'কাঠামোবদ্ধ' প্রক্রিয়া হিসেবে সালিশির মাধ্যমে এই অচলাবস্থা নিরসন করা হোক। কয়েক দিন পর রবি একই ধরনের অনুরোধ জানায়।

গ্রামীণফোন জানায়, তাদের মামলাটি — ২০১৯ সালের টাইটেল সুইট নং ৭১০ — প্রায় ছয় বছর ধরে আদালতে অগ্রগতি ছাড়াই ঝুলে আছে। তাই অডিট বিরোধের টেকনিক্যাল জটিলতার কথা উল্লেখ করে যুক্তি দেয় যে, সালিশি পদ্ধতি-ই দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারবে।

গ্রামীণফোনের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ বলেন, "গ্রামীণফোন সবসময় দায়িত্বশীল ও কমপ্ল্যায়েন্ট অপারেটর হিসেবে কাজ করেছে। ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার অডিট দাবির মধ্যে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকার অংশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায়, যা বিটিআরসির এখতিয়ারের বাইরে। আর প্রায় ৬,২০০ কোটি টাকা শুধুই সুদ। কাঠামোগত সালিশি প্রক্রিয়া এই বিরোধের সমাপ্তি টানতে পারে। যা এই সেক্টরে আস্থা ফিরিয়ে আনতেও সক্ষম হবে।"

রবির চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, "অমীমাংসিত এই বিরোধ আমাদের ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান ও কাস্টমার সার্ভিস—উভয়কেই এফেক্ট (প্রভাবিত) করছে। আমরা যেকোনো স্বচ্ছ, সময়োপযোগী ও বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করি।"

বিটিআরসির অবস্থান পরিবর্তন

বিটিআরসি সালিশির বিরোধিতা করে দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এসেছে, টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী সালিশির কোনো সুযোগ নেই। তবে সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির বক্তব্যে নমনীয়তা এসেছে।

বিটিআরসির এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, "বিদ্যমান আইনে সালিশির সরাসরি বিধান নেই, কিন্তু আমরা সম্ভাব্য উপায়গুলো খতিয়ে দেখছি। তাছাড়া অনাদায়ী টাকার ওপর সুদ বেড়ে যাচ্ছে, এটা সব পক্ষের জন্যেই ক্ষতিকর।"

কর্তৃপক্ষটি এখনও বলছে যে এসব অর্থ প্রকৃতপক্ষে সরকারের রাজস্বের অংশ, কারণ "এই অর্থ জনগণের কাছ থেকেই সংগৃহ করা হয়েছে, সুতরাং তা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেওয়া উচিত।"

প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, সরকার এই অচলাবস্থা দূর করতে সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতা করছে।

তিনি বলেন, "লাইসেন্স নিয়ে যারা টেলিকম ব্যবসা করছে, তাদের সুবিধা তো নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ সালিশি প্রক্রিয়া এটা করতে পারে। গ্রামীণফোন তাদের কনসার্নের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানিয়েছে। সরকার-ও একটা উইন-উইন সমাধান চায়।"

ফয়েজ তৈয়্যব আরও জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অডিট প্রক্রিয়ার পুনর্গঠন পরিকল্পনাও করছে; যাতে ভবিষ্যতে প্রতি বছর নিয়মিত অডিট হয়— আর এভাবে কোনো এক দশক পুরনো অর্থদাবি কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

তিনি স্বীকার করেন যে আগের সরকারের সময় বিদেশি অপারেটরদের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব একটি পক্ষপাতমূলক ধারণা তৈরি করে, অথচ একই সময়ে এই শিল্পের কিছু লোকাল সেগমেন্ট — যেমন আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) — তুলনামূলকভাবে কম নজরদারিতে ছিল।

আইজিডব্লিউ-গুলো আন্তর্জাতিক ভয়েস কল এবং আইআইজি আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ট্রাফিক পরিচালনা করে।

অডিট নিয়ে বিতর্ক: পটভূমি ও মূল বিষয়গুলো

টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিটিআরসি ও মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে দীর্ঘদিনের এই বিরোধের সূত্রপাত হয় এক বিশাল অডিট প্রক্রিয়া থেকে, যা ঘটনার বহু বছর পরে করা হয়। আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর অডিট সম্পন্ন করার বিধান থাকলেও, বিটিআরসি ২০১৭ সালে মোবাইল অপারেটরদের হিসাব পর্যালোচনা শুরু করে—যা ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়কালকে অন্তর্ভুক্ত করে।

গ্রামীণফোনের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিটিআরসির মোট ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার দাবির মধ্যে ৮,৪৯৪ কোটি টাকা বিটিআরসির কাছে (এর মধ্যে ৬,১৯৪ কোটি টাকা সুদ), আর ৪,০৮৫ কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাওনা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।

এপর্যন্ত গ্রামীণফোন পরিশোধ করেছে ২,৩৯২ কোটি টাকা—যার মধ্যে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২,০০০ কোটি এবং ২জি লাইসেন্স ফি-সংক্রান্ত রায়ে দেয়া ৩৯২ কোটি টাকা।

রবির ওপর ৮৬৭ কোটি টাকার পৃথক বকেয়া দাবি রয়েছে বিটিআরসির। ২০২০ সালে হাইকোর্ট কোম্পানিটিকে ১৩৮ কোটি টাকা কিস্তিতে পরিশোধের নির্দেশ দেয়।

অন্যদিকে, বাংলালিংকের কাছে বকেয়া দাবি প্রায় ৮২৩ কোটি টাকা, যার কিছু অংশ কোম্পানিটি পরিশোধও করেছে। তবে কিছু অংশের হিসাব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

অপারেটররা অভিযোগ করেছে, বিটিআরসি তাদের নিরীক্ষা পদ্ধতিতে এনবিআরের কাছে বকেয়া রাজস্বকেও যুক্ত করেছে, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির এখতিয়ারের বাইরে। তারা যৌগিক সুদ আরোপ এবং অনাপত্তি সনদ (এনওসি) স্থগিতকরণকেও জোরপূর্বক আদায়ের পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বাংলাদেশে সালিশির বৈশ্বিক নজির

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জ্বালানি ও বিনিয়োগ খাতে বাংলাদেশে একাধিক হাই-প্রোফাইল সালিশি মামলা হয়েছে, যা দেখায়—জটিল বাণিজ্যিক বিরোধগুলো আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে মীমাংসা করা সম্ভব।

সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণগুলোর একটি হলো নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেড বনাম পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স মামলা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি গ্যাসকূপ বিস্ফোরণজনিত ক্ষতিপূরণের দাবিতে যেটি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (আইসিএসআইডি)-তে নেওয়া হয়েছিল।

একইভাবে, একটি মার্কিন বিদ্যুৎ কোম্পানির সঙ্গে স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (আইপিপি) নিয়ে বিরোধ আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়িয়ে সালিশির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়।

আরেক ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের চুক্তিকে কেন্দ্র করে, বাপেক্স বনাম সোকার একিউএস এলএলসি (আজারবাইজানের সাথে যৌথ উদ্যোগ) — আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি হয়।

উৎপাদন খাতে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) কর্তৃপক্ষ ও জাপানি কোম্পানি মারুহিসা প্যাসিফিক-এর মধ্যে বিনিয়োগ বিরোধ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আওতায় সালিশিতে যায়, যা দেখায় যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশি এখন ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরযোগ্য উপায়ে পরিণত হচ্ছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে কোনো নির্দিষ্ট খাতে সালিশের আইনগত বিধান না থাকলেও — সালিশি প্রক্রিয়া একটি নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় হিসেবে কাজ করতে পারে।

তারা উল্লেখ করেন, পারস্পরিক সম্মতি এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্বিট্রেশন অ্যাক্ট-এর আওতায় আওতায়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক—উভয় পক্ষই সালিশি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুততর, কম বৈরিতাপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে।

সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়