শিরোনাম
◈ ফ্লোটিলার সর্বশেষ জাহাজটিও আটক করল ইসরাইল ◈ গণ-অভ্যুত্থানের পর পলাতক ৮১ পুলিশ কর্মকর্তা, ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ ◈ এক গাছেই লাখ টাকার ফল, দুই বিঘায় ২০ লাখ টাকা! (ভিডিও) ◈ কী হবে, কে জিতবে আগামী নির্বাচনে? নির্বাচনের ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা: ‘সহজ ভেবেছিলাম, কিন্তু ভুল হচ্ছিল’: মাসুদ কামাল ◈ যুক্তরাজ্যে ইহুদি উপাসনালয়ে হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ ◈ ভারতের যে গ্রামে নবীদের কবর রয়েছে! ◈ গাজার দিকে ছুটছে ফ্লোটিলার শেষ জাহাজ; পিছু না হটার ঘোষণা! (ভিডিও) ◈ বিশ্বকাপ বাছাই, দুই ম‌্যা‌চের জন্য দল ঘোষণা ফ্রান্স ও জার্মানির ◈ চল‌ছি‌লো ধর্মীয় উৎসব, গির্জার কাঠামো ধসে ৩৬ জন নিহত ◈ প্রধান উপদেষ্টার কথায় রাজ‌নৈ‌তিক নেতা‌দের ম‌ধ্যে যত বিভ্রান্তি 

প্রকাশিত : ০৩ অক্টোবর, ২০২৫, ১০:৪৩ দুপুর
আপডেট : ০৩ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:০০ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সন্ধ্যার বুকে ভাসমান চালের হাট: দুই শতকের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বরিশালের 'ভাসান মহল'

শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ। কড়কড়ে রোদের তেজও প্রখর। সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে ভেসে আসছে ছইবিহীন ছোট ছোট নৌকা। প্রতিটি নৌকার খোলে সাজানো গোলাভর্তি চাল। কোনো নৌকায় সাদামাটা ইঞ্জিন, কোনোটিতে নিছক বইঠাই ভরসা। তাঁরা সবাই কুটিয়াল—যাঁরা ধানকে রূপ দেন চালের দানায়, সেই চালকে ভাসান নদীর বাজারে। নদীর বুক যেন এক মুহূর্তে হয়ে ওঠে ভাসমান এক দোকানপাটের শহরে।

চালভর্তি নৌকাগুলো সকাল থেকেই ভিড়তে শুরু করে বরিশালের বানারীপাড়া পৌর শহরের লাগোয়া সন্ধ্যা নদীর বুকে গড়ে ওঠা হাটে। মায়াবী সন্ধ্যার জলে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে হয়ে ওঠে এক অভাবনীয় দৃশ্য। একেকটি নৌকাই যেন ভাসমান দোকান আর তার ভেতরে শতাব্দীর ঐতিহ্য। ক্রেতারা আসেন, দর-কষাকষি করেন। কেউবা আবার চালের বোঝা পাইকারি নৌকায় তুলে দেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে এই হাট। শনি ও মঙ্গলবার সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যা নদী জেগে ওঠে এক বিশেষ উৎসবে। স্থানীয় লোকজন এই হাটকে ‘ভাসান মহল’ বলে ডাকেন।

চালের হাট থেকে ধানের হাট

চালের হাট বসে নদীর এক পাড়ে। ঠিক বিপরীত পাড়ে বসে ধানের হাট। কুটিয়ালরা এখান থেকে ধান কেনেন, নিয়ে যান চাতালে। কয়েক দিনের মধ্যে সেই ধান রূপ নেয় চালের সোনালি দানায়। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে চালের হাট। এরপর জমে ওঠে ধানের হাট। ধানের মৌসুমে হাটের রং আরও গাঢ় হয়। তখন রবি ও বুধবার অতিরিক্ত হাট বসে, যাকে স্থানীয় লোকজন বলেন ‘গালা’।

একসময় এই হাট ছিল বালাম চালের মোকাম। এই চালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বরিশালজুড়ে। বানারীপাড়ার মলঙ্গা গ্রামে ছিল এই চাল প্রক্রিয়াকরণের আস্তানা। আজ সেই বালাম চাল প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্থানীয় জাতের ধান ও ব্রি ধানের চাল এখন হাটের মূল ভরসা। যদিও সেই চালে নেই বালামের সুঘ্রাণ। তবু ভাসমান হাটে মিশে আছে গৃহস্থালির মাটির গন্ধ, স্বাদে স্নিগ্ধতা।

নগদের হাট, নেই মধ্যস্বত্বভোগী

হাটের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো—সব লেনদেন হয় নগদে। বাকির কোনো প্রথা নেই। এ জন্য হাটটি ‘নগদের হাট’ নামে পরিচিত। কৃষক বা কুটিয়ালরা নগদ টাকায় ধান-চাল বিক্রি করেন। দেশের অন্য বাজারগুলোতে যেখানে পণ্য বিক্রির করতে গেলে মধ্যস্বত্বভোগীদের চোরা ফাঁদে প্রান্তিক কৃষকদের টাকা গুনতে হয়, আছে খাজনার বাজনা। কিন্তু এই হাট পুরোপুরি ব্যতিক্রম। এখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই। কাউকে খাজনাও দিতে হয় না। বিক্রেতারা নদীর বুকেই নোঙর করেন, ক্রেতা এসে পছন্দমতো ধান-চাল কিনে নিয়ে যান। স্বতঃস্ফূর্ত এই লেনদেনই ভাসমান হাটের প্রাণ।

আবদুল হাই নামের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী মনে করিয়ে দেন, পুরোনো দিনের কথা। বলেন, স্বাধীনতার আগে বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালীর খেপুপাড়া, গলাচিপা এমনকি সাতক্ষীরার ব্যবসায়ীরাও এই হাটে আসতেন। ধান বিক্রি করে চাল কিনে নিজ এলাকায় ফিরতেন। সেই সোনালি দিনের ভিড় আজ আর দেখা যায় না।

নারীদের নীরব অবদান

কুটিয়ালদের চালের নৌকা ভাসানোর আগে ঘরে রাতভর চলে প্রস্তুতি। চাল শুকানো, বস্তায় ভরা, নৌকা প্রস্তুত—সবই হয় পরিবারের সবাইকে নিয়ে। নারীরা রাত জেগে তাঁদের পাশে থাকেন। শেষ রাতে তাঁরা বিদায় জানান, নৌকা আর পুরুষ সদস্যদের। যাঁরা ভোর হতে না হতেই ভেসে পড়েন নদীর বুকে হাটের উদ্দেশে। এক অদৃশ্য অথচ অমূল্য অবদান রাখেন কুটিয়াল পরিবারের নারীরা, যাঁদের ছাড়া এই হাটের চাকা ঘুরতই না।

৩৫ বছর ধরে ভাসমান বাজারে চাল বিক্রি করা ফারুক হোসেন বলেন, প্রথমে তিনি ধান কিনে বাড়িতে নিয়ে সেদ্ধ করেন। তিন থেকে পাঁচ দিন রোদে শুকিয়ে মিলে নিয়ে চাল বানিয়ে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। এই কাজে স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে সহায়তা করেন।

দুই শতকের সাক্ষী

ভাসমান ধান-চালের হাটের জন্মকথা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। বয়োজ্যেষ্ঠদের ধারণা, অন্তত ২০০ বছর ধরে হাটটি টিকে আছে। সময়ের পালাবদলে ভাটা পড়েছে ঐতিহ্যে। তবু নদীর বুকে ভেসে চলা নৌকাগুলোই বলে দেয়—অর্থনীতির এই নদীকেন্দ্রিক ধারা এখনো নিভে যায়নি। বরং নিষ্প্রভ অবস্থায় টিকে আছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি মানুষকে সড়কনির্ভর করেছে। অটোরাইস মিলে চাল উৎপাদন হওয়ায় কুটিয়ালদের সংখ্যাও কমেছে। এতে ভাসমান হাটও তার পুরোনো রূপ হারাতে বসেছে। তবে এখনো যাঁরা হাটে আসেন, তাঁরা ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়েই আসেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূলত কুটিয়ালদের কারণে হাটটি টিকে আছে। তাঁরা কমে গেলে হাটও নিস্তেজ হয়ে যায়। তাই কুটিয়ালরাই হাটের প্রাণ। যাঁরা বংশপরম্পরায় অন্তত দুই শতাব্দী ধরে এই পেশাকে আঁকড়ে আছেন।

নদীর বুকে অমলিন কাব্য

ভাসমান চালের হাট শুধু একটি বাজার নয়, এটি নদীকেন্দ্রিক এক সভ্যতার প্রতীক। যেখানে নদীই হলো রক্তপ্রবাহ আর নৌকা হলো শ্বাসপ্রশ্বাস। কুটিয়ালদের ঘামে ধান রূপ নেয় চালের দানায় আর সেই দানা ভেসে চলে নদীর বুক চিরে। এখানে নদী কেবল জলধারা নয়; বরং বাণিজ্য, সংস্কৃতি আর লোকজ ঐতিহ্যের ধারক।

আজ যখন নদী সংকুচিত হচ্ছে, ভেসে আসছে আধুনিকতার ঢেউ। তখনো ভাসমান হাট দাঁড়িয়ে আছে সময়ের বিরুদ্ধে। হয়তো আর আগের মতো রমরমা নেই। কিন্তু আছে জীবনের স্বাদ, মাটির গন্ধ আর নদীর বুকের অমলিন এক কাব্য। সূত্র: প্রথম আলো 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়